রুমানা রাখি:
দুই বছর আগে পেনশন নিয়ে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন করতে কাকরাইলের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে ঘুরেছি প্রায় এক মাস। উদ্দেশ্য, পেনশনারদের হয়রানি আর এজি ভবনের ঘুষ বাণিজ্য খুঁজে বের করা। নিজের পরিচয় লুকিয়ে একজন সরকারি কর্মচারীর মেয়ের পরিচয়ে এজি ভবনের কর্মচারীদের কাছে পেনশনের কাগজ ছাড়ানোর জন্য সাহায্য চেয়েছিলাম আমি। প্রায় সব কর্মচারীই এগিয়ে এসেছিল সাহায্য করতে। আবার যখন সাংবাদিক পরিচয় পেল, তখন পিছিয়েও গেলো তারা। কিন্তু সবাই তো আর খারাপ না। কয়েকজন আলাদা করে দেখা করে সাহায্য কারার আশ্বাস দিলো।
মেয়ে হিসেবে বাবার টাকা পেতে এমন কষ্ট করছি দেখে, পেনশনের টাকার জন্য এভাবে ছোটাছুটি না করার জন্যও বললো তারা। আর খুব রয়ে সয়ে বললো, সবাই তো মোটা অংকের টাকা দেয় কাগজ ছাড়াতে, আপনি সাংবাদিক তাই কম দিলেও চলবে! লোকগুলোর কথা মনে ধরলো। আমার প্রতি মায়া দেখে, আমারও মায়া হলো। আর তাই পরের দিনের পত্রিকায় এই প্রস্তাবনার কথা লিখেও দিলাম।
সত্যি বলতে এই কাজটি করতে গিয়ে ঘুষের প্রচলন কবে শুরু হয়েছে এমন প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। বাংলায় ঘুষের শুরু সম্পর্কে কোথায় যেন একটি মজার রম্য পড়েছিলাম। যেখানে বলা হয়েছিলো-
আমাদের সমাজে ঘুষ-দুর্নীতি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে৷ কারণ হলো, দুর্নীতির সংজ্ঞা আমরা নিজেদের মতো করে পাল্টে নিয়েছি। সমাজের প্রতিটি স্তরেই যার যেটুকু ক্ষমতা আছে, সেটি ব্যবহার করেই অন্যায় পথে অর্থ বা সুবিধা অর্জনকে আমরা এখন রীতিমতো ‘অধিকার’ বলে মানে করছি। তবে ঘুষ বিষয়ে কারও কারও অবস্থান যৌতুক চাওয়ার মতো। যৌতুক চাওয়ার মতো সরাসরি বলে দেয় যে, ঘুষ না দিলে চাকরি বা কোনও কাজ হবে না
ব্রিটিশরা যখন বাংলায় শাসন করতো, তখন অফিসের বড় কর্তারা বাদে বাকি কর্মচারীরা ছিলো বাঙালি। একদিন সকালে এক পিয়ন দৌড়ে বড় কর্তারা কাছে এসে বললো-
-স্যার, স্যার রহিম বস ইটিং ঘুষ।
বড় কর্তা তো শুনে অবাক!
-ঘুষ! হোয়াই হি ইজ ইটিং ঘুষ? অ্যান্ড হোয়াট ইজ ইট!
বড় সাহেব ভাতের বদলে বাঙালির নতুন খাবারের নাম শুনে আশ্চর্য হলো। তাছাড়া এমন খাবারের নাম শুনে হয়তো বড় সাহেব লোভ সামলাতে পারলেন না। তাই তিনি ছুটে গেলেন রহিম বসের রুমে। গিয়ে তো বড় সাহেব অবাক! এক লোক কলার কাঁদি দিয়ে চলে যাচ্ছেন, আর রহিম সাহেব চেয়ারে পা দোলাতে দোলাতে কলা খাচ্ছেন। বস তখন নিজে একটি কলা খুলে খাচ্ছেন আর হেসে পিয়নকে বললেন-
ওয়াও! দিস ইজ ঘুষ। ইফ বানানা ইজ ঘুষ, ইটস গুড ফর হেল্থ অ্যান্ড এভরি বডি মাস্ট ইট ঘুষ।
রম্য কাব্য অনুসারে ব্রিটিশরা চলে গেলেও তাদের এই অনুমতির হাত ধরেই বাংলায় আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পরে ঘুষ নামক এতো মাজাদার একটি খাবার। ঘুষ নিয়ে এমন গল্প আর এমন রাম্য অনেকেরই জানা। ঘুষের অনেক প্রকার ভেদ। একেক রকম ঘুষে একেক জন খুশি। সবাইকে এক ধরনের ঘুষ দেওয়া যায় না, সবাই একই ধরনের ঘুষও নিতে চায় না। বাংলাদেশে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ফাইল আটকে রাখা, ‘উপরি’ নেওয়া কিংবা ‘উপহার দেওয়া’ নিন্মপদে কর্মচারীদের চা-নাস্তা খাওয়া, ‘খুশি মনে যা দেন’ টাইপের ঘুষের সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু এর বাইরে যে ধরনের ঘুষের চর্চা সবচেয়ে বেশি হয়, তা হলো পুরোমাত্রায় আনুগত্য আর তোষামোদী।
সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ঘুষ ছাড়া বাংলাদেশে সেবা পান না দেশের ৮৯ ভাগ মানুষ। দুর্নীতির শিকার ৭৫ ভাগ মানুষ কোথাও কোনো অভিযোগই করেন না। যে ২৫ ভাগ অভিযোগ করেন, তারাও মনে করেন, এই অভিযোগেরও কোনো প্রতিকার নেই। টিআইবির এই প্রতিবেদনের পর আমার মতো অনেক মানুষই আশ্চর্য হয়নি। কারণ আমরা পত্রিকা খুললেই প্রতিদিনই দেখি ঘুষের হরেক রকম সংবাদ। গত ১০ জুন দেশের প্রত্যেকটি পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়। যেখানে নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার হওয়া পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের অবৈধ সম্পদের তদন্ত করতে গিয়ে এর তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসির ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে আসে। গত ২ সেপ্টেম্বর ঘুষ নেয়ার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ফাঁদে ধরা পড়েছেন নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের শিপ সার্ভেয়ার মির্জা সাইফুর রহমান। সিলেট কারাগারের ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বনিক ৮০ লাখ টাকা ঘুষের টাকা নিয়ে গ্রেফতার হয়, জিকে শামীমকে গ্রেফতারের পর জানা যায় প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা ছিলো ঘুষের বাজেট। দৈনিক ইত্তেফাকের ২৩ সেপ্টেম্বরের এক রিপোর্টে এসেছে রিমান্ডে জি কে শামীম বলেছেন, গণপূর্ত বিভাগের এই প্রকৌশলীকেই নাকি সাড়ে ১২শ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন তিনি। তাই টিআইবির এমন প্রতিবেদনে আসলেই কি আশ্চর্য হবার কিছু আছে ?
২০০৮ সালে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি দুর্নীতিবিষয়ক একটি নথিতে দুর্নীতির বর্গীয়করণ করা হয়েছিল। সেই তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘ঘুষ’ মানে কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে টাকা, পরিসেবা বা অন্য কোনো সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। আর সরকারি লাল ফিতার ফাঁস আলগা করে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, তার নাম ‘স্পিড মানি’। এই স্পিড মানি দিয়ে কাজ দ্রুত করিয়ে নিলে খারাপ কি? উন্নত বিশ্বে এর প্রচলন আছে বলে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
আমাদের সমাজে ঘুষ-দুর্নীতি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে৷ কারণ হলো, দুর্নীতির সংজ্ঞা আমরা নিজেদের মতো করে পাল্টে নিয়েছি। সমাজের প্রতিটি স্তরেই যার যেটুকু ক্ষমতা আছে, সেটি ব্যবহার করেই অন্যায় পথে অর্থ বা সুবিধা অর্জনকে আমরা এখন রীতিমতো ‘অধিকার’ বলে মানে করছি। তবে ঘুষ বিষয়ে কারও কারও অবস্থান যৌতুক চাওয়ার মতো। যৌতুক চাওয়ার মতো সরাসরি বলে দেয় যে, ঘুষ না দিলে চাকরি বা কোনও কাজ হবে না। অনেকের থেকেই শোনা যায় টাকা বা উপহার নিয়ে ঘুরছেন কিন্তু কিভাবে দেবেন, কোথায় দেবেন, বুঝতে পারছেন না। সেটি দেওয়ারও বিশেষ নিয়ম আছে কোনও কোনও জায়গায়। টিআইবির এই প্রতিবেদন নিশ্চয়ই সরকারি কোন মহলই আমলে নিবেন না, মানতে চাইবেন না! তবে, উচিত আমলে নিয়ে যেভাবে ছাত্রলীগের ঘুষ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে, যুবলীগের ক্যাসিনো বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হয়েছে সেভাবেই ঘুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার।
লেখা শেষ করি ঘুষ নিয়ে আরেকটি মজার গল্প বলে। গল্পটি মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের মুখে শোনা। দুর্নীতির দায়ে উৎখাতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের সময় ঘুষ-দুর্নীতি এমন জায়গায় গিয়েছিলো যে, মালয়েশিয়ার পুলিশ নাকি বাকিতে ঘুষ খেতো। পুলিশ যদি রাস্তায় কোন অবৈধ অভিবাসী ধরতো তাহলে দাবিকৃত টাকা সাথে না থাকলে পরে দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ছেড়ে দিতো! এই গল্পটি প্রচলিত হয়েছিলো নাজিব রাজ্জাকের সময় ঘুষ-দুর্নীতির অবস্থা কোন জায়গায় গিয়েছিলো সেটা বুঝানোর জন্য। এর ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে নাজিব রাজ্জাককে হটিয়ে দীর্ঘ বিরতির পর আবারো দেশের হাল ধরেছেন মাহাথির বিন মোহাম্মদ। পাশের দেশের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত আমাদের।
লেখক : ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক।