মেডিকেল কলেজে চান্স পাবার পর থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ছেলেগুলো নিজেকে ভাবে শের-ই-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক আর মেয়েরা নিজেকে ভাবে ঐশ্বরিয়া রায়।
মেয়েরা এই দুই-তিন মাস উচ্চাভিলাষী সাজগোজ আর পোজ দিয়ে ছবি তুলবে আর ফেসবুক ইন্সটাগ্রামে আপলোড করে বেড়াবে। ত্রিশ টাকার ফুচকা খেতে গিয়ে ত্রিশটা সেলফি তুলে সবগুলো একই ক্যাপশনে আপলোড দেবে। তাদের স্ট্যাটাস, ছবিতে লাইক কমেন্টও পূর্বের তুলনায় সূচকীয় হারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
ওই সময়ে ব্যাচমেট কেউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে তাকে রাখবে নিতান্তই বাচ্চা ছেলের কোটায়। ফোর্থ-ফিফথ ইয়ার হলে নাহয় একটা বিষয় ছিলো!
ক্লাস যখন শুরু হবে দুদিন পর তখন আর ভর্তি কোচিং বা চান্সপরবর্তী ঘোরাঘুরির সময়কার মতো সাজুগুজু করে ক্লাসে যাবার সময় থাকবে না। ঘুম থেকে উঠে সকালের লেকচার ধরতেই জান যায় যায়, সেখানে আবার সাজুগুজু!
দু-তিন বছর যখন যায় যায় তখন তাদের মনে হয় ব্যাচমেটরা বড় হয়ে গেছে। অনেকের মুখে দাড়ি গজিয়েছে।
ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে নতুন ব্যাচ আসে। নতুন ব্যাচ আসার সাথে ছেলেদের খুশি হওয়ার কী সম্পর্ক বা মেয়েদের জেলাস হবার কী আছে তা জানি না। শুধু জানি লালন ফকির তার গানে গানে বলে গেছেন- ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।
সেই শিশুরা ততোদিনে কারো কারো বাবুতে পরিণত হয়।
এ নিয়ে কলেজের সাবেক এক ব্যাচের ম্যাগাজিনে এক আপুর লেখা একটা ছড়া পড়েছিলাম। যার ভাবার্থ অনেকটা এ রকম-
মেয়েরা ফার্স্ট ইয়ারে প্রপোজাল এলে জিজ্ঞেস করে – তার হাইট কতো?
থার্ড ইয়ারে প্রপোজাল এলে জিজ্ঞেস করে – সে কিসে পড়ে?
ফোর্থ ইয়ারে প্রপোজাল এলে জিজ্ঞেস করে – সে কী করে?
ফিফথ ইয়ারে প্রপোজাল এলে আর কিছু জানতে না চেয়ে জিজ্ঞস করে – কোথায় সে?
মেডিকেল শিক্ষাজীবনে এবং কর্মজীবনে যখন কর্মস্থলে যায় তখন হয়তো মনে মনে ভাবে সত্যিই যদি বিশ বছর পেছনে যাওয়া যেতো তাহলে হয়তো মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফর্মই তোলা হবে না আর। জেনেশুনে বিষ পান করার ইচ্ছে সকলের হয় না।
অন্যদিকে ছেলেদের ভাব-বচনে এ দুই-তিন মাস শুধু জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য ঝরে। বাসে উঠলে ভাবে এই বাসে একজন হবু ডাক্তার বসে আছে। জাতীর অমূল্য রত্ন। এই ফিটনেসবিহীন বাস কেন যে দেশে চলে? আজ যদি এই বাসের কিছু হয় তো গোটা জাতীরই কিছু একটা হয়ে যাবে। আর এই ড্রাইভার আর কন্ট্রাক্টরের কী অসহায় জীবন! সারাদিন মানুষের গালি হজম করা লাগে। তাদের বংশমর্যাদায় দৈনিক এতই গালি পড়ে যে, বাজারের মোড়ে ঝোলানো মাজারের দান বাকশোতেও দৈনিক এত টাকা জমা হয় কিনা সন্দেহ।
সি এন জি ঠিক করতে গেলে সি এন জি ড্রাইভার যদি বলে- ‘মামা আপনাকে দিয়েই দিন শুরু করতাছি, সার্জন (সার্জেন্ট) ধরলে কইয়েন মিটারে যাইতাছি’।
হবু ডাক্তার হালকা গলা ঝেড়ে বলার ইচ্ছা পোষণ করে – ‘আরে মামা, আপনার সৌভাগ্য যে, একজন হবু ডাক্তারকে দিয়ে খ্যাপ শুরু করলেন, টান দেন, সমস্যা হবে না, বিষয়টা আমি দেখবোনে’।
কালের বিবর্তনে মেডিকেলে ক্লাস শুরু হলে স্যার যখন বলেন- এতদিন মজা মাস্তি যা করছো ভুলে যাও, একদিন রেস্ট দিলাম। আগামী সোমবার বোন্স এন্ড জয়েন্টের প্রথম আইটেম।
তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কোচিংয়ের ভাই বলেছিলো – এখন মজা মাস্তি সব বাদ দাও, সব মজা মাস্তি চান্স পাওয়ার পর কোরো।
বাবা মা বলেছিলেন- চান্সটা পেলে যা ইচ্ছা করতে পারবি, এখন শুধু বাধ্য ছেলের মতো আমাদের কথা মেনে চল।
কোচিংয়ের স্টাইলিশ ভাইয়াটা বলেছিলো চান্সটা পেলেই অনেকগুলো প্রেমের অফার আসবে। এখন পড়াশোনায় মন দাও। আর এদিকে চান্স পাওয়ার পর ক্যাম্পাসে কারো চোখে সে মুরগী, কারো চোখে দুগ্ধপোষ্য শিশু। স্যারের ভাষায় মজা মাস্তির দিন পার করে এসেছো। এখন পড়াশোনার সময়।
তখন সে ভাবে – ওই ফিটনেসবিহীন বাসের ড্রাইভার আর কন্ট্রাক্টর কতোইনা সুখী মানুষ! ওই সি এন জিওয়ালা মামা কত সুন্দর করে মনের আনন্দে বলে – মামা আপনাকে দিয়াই শুরু করতাছি।
এটলিস্ট তাদের রাতের ঘুমটা আরামে হয়।
আরো কবছর পর যখন মেডিকেল জীবনের সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে থাকে তখন আবারো মনে মনে ভাবে- আহারে ওই ড্রাইভার, কন্ট্রাক্টর আর সি এন জিওয়ালারা কতোই না সুখে আছে। এটলিস্ট তাদের দোষেই মানুষ তাদের গালি দেয়। বিনা দোষে গালি খাওয়ার মানসিক কষ্টে তাদের ভুগতে হয় না।
ডাক্তারি পড়ছি বা ডাক্তার হয়েছি শোনা মাত্রই আশপাশে দাগী আসামি দেখার মতো জটলা পেকে যায়। মানুষ বলতে শুরু করে – অমুক ডাক্তার আমাকে পাঁচ মিনিট দেখে, দুইটা ঔষধ লিখে দিয়েই বলে পাঁচশ টাকা দ্যান, কত্তবড় কসাই’।
তারা জানে না ওই পাঁচ মিনিট দেখে দুটো ঔষধ লেখার জন্য ওই ডাক্তারকে কত বছর বইয়ের ভেতর মাথা গুঁজে রাখতে হয়েছে। বইয়ে অন্য পেশার ছাত্ররাও মাথা গুঁজে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তারা রেস্ট পায় ওই অত্যাচার থেকে। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যা এমন এক জগৎ, একটা বছর যায় আর একজন ছাত্রকে শুনতে হয়- এত বছর কীইবা পড়েছো, আসল পড়া শুরু হবে এবার!
জটলায় পাশ থেকে আরেকজন বলে- ‘আর বইলেন না, ওইদিন ওই পোরবেসার (প্রফেসর) আমাকে দুই হাজার টাকার টেস্ট করাইতে দিলো, কিন্তু রিপোর্টে সব নরমাল। কত্ত বড়ো কসাই, সব নরমালই যদি আসে এত টাকার টেস্ট দিলো কেন?’
তার দুই হাজার টাকার টেস্টের ভেতর একটা রিপোর্টে ক্যান্সার বা মরণব্যাধি কোনো রোগের সাসপেক্টেন্স এলে বোধহয় সে এবং তার পরিবার খুব খুশী হতো। এটলিস্ট তার দুই হাজার টাকা এভাবে ‘জলে ভেসে’ যেতো না।
এসব অবস্থা থেকে মানুষকে দেখে হিংসে হয়। তারা কতো আরামে, নিশ্চিন্তেই একটা পেশাকে অবিরাম গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। অথচ কাল সকালে এরাই ওই ডাক্তারদের কারো চেম্বারে বা কর্মস্থলে এসে কান্না জড়ানো গলায় বলবে – ‘স্যার, আমার ছেলে/মেয়েটারে বাঁচান। আমারে বাঁচান। আমার কিছু হইলে বউ বাচ্চারে কে দেখবে?’
তখন আর তার মাথায় থাকে না – ‘বাঁচানোর মালিক ডাক্তার নয়’।
ডাক্তারের উছিলায় বেঁচে গেলেও যাওয়ার সময় বলবে- ‘গতবারের ডায়রিয়ার সময় ফার্মেসিওয়ালার দুইডা অ্যান্টিবায়োটিকেই পেট ঠিক হয়ে গেছিলো, এ ডাক্তারে হুদাই দুইদিন স্যালাইন দিয়া রাখছে। সবই ওষুধ বেচার ধান্দা’।
সে জানেই না ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হয়ে তার কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
অবশেষে সবাইকে এ বিচিত্র জগতে স্বাগতম। কারো চোখে তুমি কসাই, কারো চোখে তুমি মশাই।
লেখক: মেডিকেল শিক্ষার্থী।