ডেস্ক রিপোর্ট:
ফেনীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে (১৮) নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যা মামলার আসামি ১৬ জন। তাদের মধ্যে ১২ আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ১৬৪ ধারায় তারা নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। নুসরাতকে হত্যার সাড়ে ছয় মাসের মাথায় এই মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর)। রায়ে ১৬ আসামি সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। নুসরাত হত্যায় কোন আসামির কি ভূমিকা ছিল তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
নুসরাত হত্যা মামলার আসামিরা হলেন— সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
যারা জবানবন্দি দিলেন,
নুর উদ্দিন
নুসরাতকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে। তার অনুসারী নুর উদ্দিন ১ ও ৩ এপ্রিল কারাগারে সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে অধ্যক্ষ সিরাজের পরামর্শে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নুসরাতকে আগুন দেওয়ার সময় নুর গেটে পাহারার দায়িত্বে ছিলেন। নুর প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে নুসরাতের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। তাই নুসরাতের ওপর তার প্রতিহিংসা ছিল।
শাহাদাত হোসেন শামীম
মাদরাসার সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে যখন নুসরাতকে ডেকে নেওয়া ও আগুন দেওয়া হয়, তখন উপস্থিত ছিলেন শামীম। শামীম স্বীকারোক্তিতে বলেন, আমি নুসরাতের মুখ চেপে ধরি। দিয়াশলাই কাঠি দিয়ে আগুন ধরানোর জন্য জোবায়েরকে ইশারা করি।
নুসরাতকে হত্যার উদ্দেশে বোরকা ও কেরোসিনও কেনেন এই শামীম। সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম কিলিং মিশন বাস্তবায়নের জন্য শামীমকে টাকা দিয়েছিলেন। সে টাকাও ভাগ-বাটোয়ারা করেন শামীম।
আব্দুর রহিম শরীফ
সিরাজের অনুগত ও নুসরাত হত্যার আসামি শরীফ নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি ২৮ ও ৩০ মার্চ দুই দফা কারাগারে থাকা সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। সিরাজের মুক্তির দাবিতে গঠিত ‘অধ্যক্ষ সাহেব মুক্তি পরিষদের’ সভা হয় নুসরাত হত্যাকাণ্ডের দুদিন আগে ৪ এপ্রিল। হত্যা পরিকল্পনায় শরীফের দায়িত্ব পড়ে মাদরাসার গেটে।
হাফেজ আব্দুল কাদের
হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন কাদের। ২৮ ও ৩০ মার্চ তিনি মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে কারাগারে দেখা করেন। তার শয়নকক্ষেই ‘অধ্যক্ষ সাহেব মুক্তি পরিষদের’ সভা ও নুসরাতকে হত্যার চক্রান্ত।
উম্মে সুলতানা পপি
নুসরাত হত্যার ঘটনায় পপি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী। সে নুসরাতকে ডেকে সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলার ছাদে নিয়ে যায়। কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়ার সময় পপি নুসরাতের পা ধরে রাখে।
জাবেদ হোসেন
জাবেদ পলিথিন থেকে নুসরাতের সারা শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেন। তিনি ২৮ ও ৩০ মার্চ দুই দফা কারাগারে থাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
কামরুন নাহার মনি
নুসরাতকে হত্যার সময় মনি নুসরাতের বুকসহ শরীর চেপে ধরেন। সহঘাতক পপি নুসরাতের পা বাঁধার সময় তিনি পপিকে শম্পা বলে ডাকেন। এই কিলিং মিশনে আর কোনো ছদ্ম নাম ব্যবহার করা হয়নি। নুসরাতকে হত্যার সময় তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। পরবর্তীতে কারাগারে সন্তান প্রসব করেন।
আবদুর রহীম শরীফ
রহীম মাদ্রাসার গেটে পাহারায় ছিলেন।
এমরান হোসেন মামুন
তিনিও গেটে প্রহরায় ছিলেন যাতে কিলিং মিশনে কেউ প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করতে পারে।
ইফতেখার উদ্দিন রানা
রানারও দায়িত্ব ছিল গেটে থেকে নজরদারি করা।
মহিউদ্দিন শাকিল
হত্যার পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের দিন পাহারার দায়িত্ব ছিলেন শাকিল।
সিরাজ উদদৌলা
নুসরাত হত্যার নির্দেশদাতা ও মূল পরিকল্পনাকারী সিরাজ। কারাগারে আটক সিরাজের সঙ্গে মামলার আসামি শামীম ও নুর উদ্দিন ফেনী কারাগারে দুইবার দেখা করেন। তখন সিরাজ তাদের নির্দেশ দেন নুসরাতকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে। এ প্রস্তাবে নুসরাত রাজি না হলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন। পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালাতে বলেন।
পাঁচ জনের কিলিং মিশন, কার কী ভূমিকা?
নুসরাতকে হত্যার সময় তাকে বারবার বলা হচ্ছিল অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে। নুসরাত রাজি না হলে শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতের মুখ চেপে ধরে। উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতের পা ধরে রাখে। মনি বুকের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে। জাবেদ হোসেন পলিব্যাগে থাকা কেরোসিন নুসরাতের পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢেলে দেয়। জোবায়ের নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে হাত-পা বাঁধে। ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।