অপরূপ সৌন্দর্য্য ঘেরা পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি। যার দূরত্ব ঢাকা থেকে ২৬৬, চট্টগ্রাম থেকে ১১২, কুমিল্লা থেকে ১৭০, চাঁদপুর থেকে ২২৮ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ি জেলার আয়তন হচ্ছে ২৬৯৯.৫৫ বর্গকিলোমিটার। প্রকৃতি অকৃপণভাবে সাজিয়েছে খাগড়াছড়িকে। স্বতন্ত্র করেছে বিভিন্ন অনন্য বৈশিষ্ট্যে। এখানে রয়েছে আকাশ-পাহাড়ের মিতালী, উপত্যকার বিস্তীর্ণ সমতল ভূ-ভাগ ও উপজাতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যতা।
কি ভাবে যাবেন: সারাদেশ থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। আপনি যেখান থেকেই যাত্রা শুরু করেন, ভোর বেলা খাগড়াছড়ি পৌঁছতে হবে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যেতে চাইলে শ্যামলী, এস আলম, ঈগল, এনা, সৌদিয়া, শান্তি পরিবহন, ইয়ার-৭১, সেন্টমার্টিন, হানিফ ও বিআরটিসি বাসে যেতে পারেন। ঢাকা কলাবাগান, গাবতলী, মতিঝিল, সায়দাবাদ থেকে বাস পাওয়া যায়। ভ্রমণের জন্য ৮-১২ জনের গ্রুপ হলে মাইক্রোবাস ভাড়া করে অথবা ছোট পরিবার হলে ছোট কার ভাড়া করে যেতে পারেন। চট্টগ্রামের কদমতলী, বদ্দারহাটসহ শহরে কয়েকটি স্থান থেকে বাসে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়। তবে অক্সিজেন মোড় থেকে প্রতি ঘণ্টায় শান্তি পরিবহন পাওয়া যায়। ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর থেকে সরাসরি খাগড়াছড়ি বাস রয়েছে। ছুটির দিন ভ্রমণ করতে চাইলে আগে থেকে টিকেট বুকিং দিয়ে রাখা ভালো। একদিন ভ্রমনের জন্য অবশ্যই রাতে যাত্রা শুরু করবেন, যাতে করে ভোর বেলা খাগড়াছড়ি পৌঁছানো যায়।
নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য ঘেরা খাগড়াছড়ির আঁকা-বাঁকা, উচুঁ-নিচু পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলার সময়টা আপনার জন্য স্বরণীয় হয়ে থাকবে। চারদিকে ছোট-বড় সারি সারি পাহাড়, গাছ-পালা, জঙ্গল, সবুজের সমারোহ আপনাকে ভুলিয়ে দিবে সব ক্লান্তি। এনে দিবে আনন্দ আর প্রশান্তি।
খাগড়াছড়ি এক দিনে যা দেখবেন: প্রথমে শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রিছং ঝর্ণা, রিছং ঝর্ণা থেকে ফেরার পথে ৩ কিলোমিটার দূরে আলু টিলা, অপরাজিতা বৌদ্ধ বিহার, ৩ কিলোমিটার দূরে রয়েছে জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক, পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, সবশেষে আধিবাসী মার্কেট ঘুরে দেখা যাবে (যারা এক রাত থাকতে চান, তারা ভ্রমনের তালিকায় যোগ করতে পারেন- তৈদুছড়া, দেবতার পুকুর, মহালছড়ি হৃদ, শতায়ুবর্ষী বটগাছ, ভগবান টিল, দুই টিলা ও তিন টিলা, মানিকছড়ি মং রাজবাড়ি, রামগড় লেক ও চা বাগান।
ভোর বেলা বাস থেকে নেমে একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে (জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা) ৭.৩০ মিঃ মধ্যে বের হয়ে যাবেন।
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ করবেন কিভাবে: প্রথমত নিজেদের ভাড়া করা ভ্রমণ গাড়িতে ঘুরতে পারেন। ভাড়া গাড়ী না থাকলে সিএনজি, জিপ, মোটরসাইকেল ভাড়া নিতে পারেন অথবা স্থানীয় লোকাল বাসে চড়ে দর্শণীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। যাতায়াত খরচ তেমন বেশি হবে না। কারণ একদিনের দর্শণীয় স্থান গুলো ১০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে। তবে আলু টিলা ও হর্টিকালচার পার্ক এর প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা। ভ্রমনের শুরুতে চলে যাবেন রিছং ঝর্ণা।
‘জিপ (চাঁদের গাড়ী) ড্রাইভার মোবাইলঃ ০১৬৩৪৮৪৭৬৫৬, মোটর সাইকেল মোবাইলঃ ০১৮২৮-৯৪২৬৩৪।’
রিছং ঝর্ণা: শহর থেকে ১০ কি.মি, মূল পাকা সড়ক থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার ভিতরে এই ঝর্ণা। গাড়ী নিয়ে দেড় কিলোমিটার পযন্ত যাওয়া যাবে। বাকীটুকু পায়ে হাটা পাহাড়ী পথ, তবে পাহাড়ের পাদোদেশ থেকে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে সরু মেঠো পথে আস্তে আস্তে হাটি হাটি পা পা করে উপরে-নিচে। গাঁ শির শির করা ভয়, সাথে আনন্দ আর পুলক ছড়িয়ে পড়ে মনেপ্রাণে। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা, যেন নতুন কিছু জয় করার মত আনন্দ। প্রায় আধা কিলোমিটার আগে থেকেই ঝর্ণার পাশে পাহাড়ের কোলে কোলে ইট-সুরকির ২৩৬টি সিড়ি রয়েছে, দু’পাহাড়ের পাদদেশে যাওয়ার জন্য। তারপর আবার মাটির সিঁড়ি রয়েছে প্রায় ৫০টি উপরে দিকে যাওয়ার জন্য, এই দু’সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া যাবে ঝর্ণার সং¯পর্শে। ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে যে ক্লান্তি আসবে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে এক নিমিষেই। অপূর্ব এই ঝর্ণা দিকে আপনি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবেন। নয়ন আবিরাম ঝর্ণা আপনাকে এনে দিবে প্রশান্তি। আর শুনবেন ঝর্ণা ঝরার শব্দ। দেখতে পাবেন ঝর্ণার নির্মল স্বচ্ছ পানির হৃদ। চারদিকে সবুজের সমাহার। যেখানে প্রকৃতি কথা বলে কবিতার ভাষায় (আপনার সাথে আলাদা কাপড় থাকলে ঝর্ণার পানিতে ভিজতে পারেন, তবে সাবধান-ঝর্ণার তলদেশ খুবই পিচ্ছিল ও ভয়ংকর)। রিছং ঝর্ণা ভ্রমণে গেলে প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য্য ও ঝর্ণা ধারার তাল আপনার মনকে ফিরে আসতে বাধা দিবে। তারপরেও ১০.৩০ টার মধ্যে ফিরতে চেষ্টা করবেন।
আলু টিলা: রিছং ঝর্ণা থেকে ফিরতি পথে ৩ কিলোমিটার দূরে রয়েছে আলু টিলা। আলু টিলা পাহাড় থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহর দেখা যায়। আলু টিলার প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা আর মশাল ৫ টাকা। চালাক হলে আপনি ২০ টাকায় টিকেট ও মশাল নিতে পারবেন। আলু টিলার মূল আকর্ষণ হলো, আশ্চর্য প্রাকৃতিক অন্ধকার সুরুঙ্গগুহা। গেট থেকে আধা কিলোমিটার নি¤œমুখি রাস্তা হেটে বা গাড়িতে যেতে পারেন।
তারপর ২৬৬ ধাপ সিঁড়ি রয়েছে আস্তে আস্তে নিচে নেমে যাবেন গুহার মুখে। ২৮২ ফুট অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করতে প্রথমে ভয় পেলেও পরে পুলকিত হবেন। গুহার ভিতর থেকে একটা ঝিরঝির পানির প্রবাহ বয়ে চলছে। বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক অন্ধকার গুহা এটি। এই গুহায় প্রবেশ করলে আপনি সত্যিকার অর্থে জীবনের থ্রিলিং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। অন্ধকার, ঠান্ডা শিতল, গা শির শির করা ভয়, পায়ে নিচে পাথরে টুকরো। কোথাও কোথায় মাথা নিচু করে পার হওয়া। সবকিছু পিছনে ফেলে আপনি যখন গুহার অপর প্রান্তে পৌঁছবেন, তখন নিজেই আবেগ আপ্লুত হয়ে আশ্চার্য হবেন। কি ভয়ংকর থ্রিলিং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আবারো গুহার অপর প্রান্ত দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসবেন। মনে রাখবেন, একবার গুহার ভিতরে ডুকলে, পিছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নাই। কারণ আপনার পিছনে পিছনে অনেক মানুষ ঢুকে পড়েছে। ফিরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দুপুর ১২টায় আলুটিলা থেকে বেরিয়ে পড়বেন। মনে রাখবেন, রিছং ঝর্ণা ও আলু টিলার আশেপাশে কোন খাওয়া হোটেল ও টয়লেট নাই। ঘুরা-ঘুরির মাঝে যা খাবেন তাহলো ডাব প্রতি পিস্ ৩০-৫০ টাকা। পাহাড়ী কলা প্রতি পিস্ ১-৩ টাকা, পেপে প্রতি পিস্ ২০-৫০ টাকা, পাহাড়ী আনারস প্রতি পিস্ ১৫-৩০ টাকা, পেয়ারা, বড়ই (কুল), চা ১০টাকা, কফি ২০-৩০ টাকা।তবে পরবর্তী দশণীয় স্থান হটির্কালচার পার্কে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
হটির্কালচার পার্ক: আলুটিলা থেকে ৩ কি.মি. দূরে হটির্কালচার পার্ক। হর্টিকালচার পার্ক এর ভিতরে ঢুকার আগেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতে পারেন। গেইটের বাহিরে পুডাং থাং রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যোগাযোগ: ০১৭৫৬-৮৪৬৬৬৭, মেনু হিসেবে ১২০ থেকে ২৫০ টাকায় জনপ্রতি খাওয়া যাবে। এখানকার কাষ্টমারদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা আছে।
কি আছে এই পার্কের ভিতরে: প্রায় ২০০ মিটার ঝুলন্ত ব্রীজ, কিডস জোন, সবুজ বেষ্টনী, পিকনিটক স্পট, কৃত্রিম হৃদ, হলরুম, ওপেন স্টেজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ পাহাড়ী শান্ত হৃদ।
২২ একর পাহাড় জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে এই হর্টিকালচার হ্যারিটেজ পার্ক। পাহাড়ের চূড়ায় আধুনিক সাজসজ্জায় নির্মিত পার্ক এটি। সেখানে আধিবাসীসহ সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ কারির দেখা পাবেন। ২-৩ ঘন্টা সময় কাটাতে পারেন এই পার্কে। সন্ধ্যার কিছু আগে বের হয়ে যাবেন।
পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র: পার্ক থেকে বের হয়ে সোজা চলে যেতে পারেন পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরতে পারে এখানে।
সন্ধ্যার পর যেতে পারেন শহরের আবিধাসী মার্কেটে। পছন্দ হলে কেনা কাটাও করতে পারেন সেখানে।
তারপর পছন্দ মতো রাতের খাবার খেয়ে (মেনু হিসেবে জনপ্রতি ১২০-২৫০ টাকায়) বাসে চড়ে বসবেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।
যারা থাকতে চান, তারা পরের দিন বাকি স্পট গুলো ঘুরে দেখতে পারেন।
কোথায় থাকবেন: খাগড়াছড়িতে পর্যটন মোটেল সহ বিভিন্ন মানের থাকার হোটেল আছে ।
পর্যটন মোটেল: এটি শহরে ঢুকতেই চেঙ্গী নদী পার হলেই পড়বে। মোটেলের সব কক্ষই ২ বিছানার। ভাড়া: এসি ২১০০ টাকা, নন এসি ১৩০০ টাকা। এসি স্যুইট রুম ৩,১০০ টাকা। তবে পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ভোল্টেজ ওঠানামা করায় এসি রুমগুলো নন-এসি হিসেবে ভাড়া দেয়া হচ্ছে। যোগাযোগ: ০৩৭১-৬২০৮৪৮৫।
হোটেল ইকোছড়ি ইন: ভালো মানের হোটেল, রুম ভাড়া প্রতি রাত ১৫০০ টাকা ২/৩জন থাকা যাবে। বড় রুমের ভাড়া আনুমানিক হারে বাড়বে। গরম পানি এসিসহ সকল সুবিধা পাবেন। উপরে রুম নিলে খাগড়াছড়ি শহরের মনোমুগ্ধকর পাহাড়ী পরিবেশ দেখা ও উপভোগ করা যাবে। যোগাযোগ: ০৩৭১৬২৬২৫, মোবাইল: ০১৮২৮৮৭৪০১৪, হোটেল শৈল সুবর্ণ: ০৩৭১-৬১৪৩৬ , ০১১৯০৭৭৬৮১২, হোটেল জেরিন: ০৩৭১-৬১০৭১, হোটেল লবিয়ত: ০৩৭১-৬১২২০, ০১৫৫৬৫৭৫৭৪৬, ০১১৯৯২৪৪৭৩০, হোটেল শিল্পী: ০৩৭১-৬১৭৯৫।
কোথায় খাবেন: খাগড়াছড়ি গেলে আদিবাসী খাবারের স্বাদ নিতে চান? শহরের পানখাইয়া পাড়া, মহাজনপাড়া এলাকায় বেশকিছু আদিবাসী খাবারের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যারা পাহাড়ে এসে পাহাড়ি খাবার খেতে চান তাদের জন্য ওই রেস্টুরেন্টগুলো।
যারা থাকার হোটেলে রাতের খাবার খেতে চান তারা আগে থেকেই মেনু সহ অর্ডার করে রাখবেন। কমন রেষ্টুরেন্টে খেতে চাইলে, খাগড়াছড়ি শাপলা চওর রেষ্টুরেন্ট গুলোতে রাতের খাবার খেয়ে তার পর হোটেলে যেতে পারেন।