সমাজের বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের মতো উন্নত পরিবেশে শহরের নামিদামী স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও নিজের স্বপ্ন পূরণের দৌড়ে একেবারেই পিছিয়ে নেই মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে পদ্মার ভাঙন কবলিত জনপদে আট বছর বয়সী ছোট্ট শিশু সুজয়ের মতো অনেকেই। কারণ হরিরামপুর ভাঙন কবলিত জনপদে উদ্যমী কলেজ শিক্ষার্থী মীর নাদিম হোসেন ও তার সহপাঠীরা মিলে গড়ে তুলেছেন ‘পদ্মা পাড়ের পাঠশালা’ নামের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নিজেদের টিউশনের টাকা বাঁচিয়ে পাঠশালাটিতে অধ্যায়নরত ৫৪ শিশুকে তারা কিনে দিচ্ছেন বই, খাতা, কলম।
এই পাঠশালাতেই সুজয়ের মতো পদ্মা পাড়ের অনেক অসহায় দরিদ্র ও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বিনা খরচে লেখা পড়া করছে। নিজেদের স্বপ্নের কথা জানালো শিশু মীম ও নিশিও। তারা পড়ালেখা করে ডাক্তার হয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়াতে চায়।
.
৩০ বছর ধরে ক্রমাগত ভাঙনে হরিরামপুর উপজেলার মানচিত্র ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে গেছে। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ জনপদ পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। হাজারও পরিবার তাদের পৈত্রিক ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুহারা হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকের ঠিকানা এখন রাস্তার পাশে, বস্তিতে কিংবা অন্যের জমিতে। পদ্মায় সবহারা পরিবারের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদের মধ্যে কোনও কোনও পরিবার তাদের শিশুদের টাকা পয়সা খরচ করে স্কুলে পাঠাতে সক্ষম হলেও অধিকাংশ থেকে যাচ্ছে শিক্ষার বাইরে। এই শিশুদের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই এগিয়ে আসেন মীর নাদিম হোসেন। তিনি মানিকগঞ্জ সরকারী দেবেন্দ্র কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবা একটি কলেজে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। মা, বাবা ও এক বোন নিয়ে নাদিমের সংসার। জন্মের পর থেকেই পদ্মা ভাঙন দেখে আসছেন নাদিম। দেখেছেন প্রতিবেশী, আপনজনের ঘরবাড়ি হারানোর হাহাকার। অনার্স পড়ার সময় থেকে টিউশনি শুরু করেন নাদিম। তখনই ভাঙন কবলিত পরিবারের শিশুদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়ার পরিকল্পনা এঁটে নেন। চলতি বছরের মার্চ থেকে নাদিম চালু করেন পাঠশালার কার্যক্রম। হরিরামপুরের আন্দারমানিক গ্রামে নিজেই ৫০০ টাকায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চালু করেন ‘পদ্মা পাড়ের পাঠশালা।’ বর্তমানে সকাল ও বিকেলে দুই শিফটে মোট ৫৪ জন শিশু এই পাঠশালায় লেখাপড়া করছে।
.
গ্রামে ঘুরে ঘুরে জোগাড় করেন শিক্ষার্থী। বর্তমানে নাদিম ছাড়াও সহপাঠী রবিন্দ্র এবং নিশা শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করানোর পাশাপাশি সাধ্যমতো সহায়তা করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি স্থানীয় দুই ব্যবসায়ী পাঠশালার জন্য ৫ জোড়া বেঞ্চ দিয়ে সহায়তা করেছেন। পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা মীর নাদিম হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ পাঠশালার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিংবা সমাজের বিত্তশালীদের পৃষ্ঠোপোষকতার প্রয়োজন। বিত্তশালীদের সহায়তায় পাঠশালাটির সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা আরও ভালো পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে।’
পদ্মা পাড়ের পাঠশালা নিয়ে কথা হয় হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইলিয়াস মেহেদীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পদ্মা পাড়ের পাঠশালাটি ইতোমধ্যে ভাঙন কবলিত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় ও আস্থা অর্জন করেছে। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মীর নাদিম হোসেনসহ উদ্যোক্তারা এসেছিলেন। শিক্ষার্থীদের একটি তালিকাও দিয়েছেন। তাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতটুকু সাহায্য সহযোগিতা করা যায় তার সবটুকু করা হবে।’
এদিকে জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস বলেন, ‘আসলে কাজটি প্রশংসা পাওয়ার মতো। বাস্তব অবস্থা দেখে পদ্মা পাড়ের পাঠশালাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হবে।’