ডেস্ক রিপোর্ট: করোনাভাইরাস গরম আবহাওয়ায় বেঁচে থাকতে পারে না, অনেকেরই এমন ধারণা। আবার অনেকে আশা করছেন তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কেটে যাবে।
তবে জানেন কি? আপনি যা ভাবছেন তা একেবারেই সত্যি নয়। কারণ গ্রীষ্মপ্রধান অনেক দেশ আছে যেখানেও করোনা পৌঁছে গেছে এবং প্রভাবও বিস্তার করছে। এমনকি সেখানে করোনার প্রাদুর্ভাব অন্যান্য শীতল অঞ্চলের থেকে তুলনামূলক বেশি। অনেকেরই এমন ধারণা হওয়ার কারণ হলো, শীতকালে অনেক ফ্লুর সংক্রমণ দেখা যায়। যা গ্রীষ্মকালে সংক্রমিত হয় না।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম দেখা দেয় কোভিড-১৯। এ ভাইরাসের নামকরণও করা হয় চীনে। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। এটি বন্য বাদুড় এবং সাপের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ছোঁয়াচে হওয়ায় খুব দ্রুত তা সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। বিশ্বজুড়ে এই মরণব্যাধিতে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ। দিন দিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সেইসঙ্গে যোগ হচ্ছে মৃতের সংখ্যাও।
যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ কেট টেম্পিলটনের ১০ বছর আগের এক গবেষণায় এই ভাইরাসটি পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, একটি হাসপাতালে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীরা তিনটি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। আর সেসময়টা ছিল শীতকাল। এমনকি তখনো তারা কোভিড-১৯ এর ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। এ গবেষণা থেকে গবেষকরা নিশ্চিত হন যে করোনাভাইরাস শীতল এবং গরম সব আবহাওয়ায় বেঁচে থাকতে পারে এবং সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
অপ্রকাশিত আরো কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার জন্য শীত বা গ্রীষ্ম কোনো আবয়াহাওয়াই দায়ী নয়। এটি যে কোনো সময়ই একজনের থেকে অন্যজনের দেহে প্রবেশ করতে পারে। বৈশ্বিক কোনো পরিবর্তন করোনাভাইরাস ধ্বংস করতে পারে না। এ গবেষণায় আরো বলা হয়। শীতকালীন উষ্ণ এবং ঠাণ্ড জলবায়ু বর্তমান কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পক্ষে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
গবেষকরা বলছেন, বিশ্বের ক্রান্তীয় অংশগুলো সম্ভবত সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এই মরণব্যাধি থেকে।স্টকহোমের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটে ভাইরাস সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের অধ্যাপক জ্যান অ্যালবার্ট বলেন, একসময় আমরা কোভিড-১৯ এর থেকে রেহাই পাব। এই ভাইরাস সম্পর্কিত গবেষণা থেকে আরো জানা যায়, করোনাভাইরাস চর্বির মতো। এটি ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে অনেকটা রাবারের ন্যয় ধারণ করে আর গরমে কিছুট তরল থাকে।
গবেষণা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে, সার্স-কোভ-২ বা কোভিড-১৯ ভাইরাসটি ২১ থেকে ২৩ সেলসিয়াস বা ৭০ থেকে ৭৩ ফারেনহাইট তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়াও ৪০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় প্লাস্টিক এবং স্টেইনলেস স্টিলের মতো শক্ত পৃষ্ঠগুলোতেও ৭২ ঘন্টা অবধি বেঁচে থাকতে পারে। তবে অন্যান্য করোনাভাইরাসগুলো ৪ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও ২৮ দিনের বেশি বেঁচে থাকতে পারে।
জানেন কি? ১৯১৮ সালের মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু কিন্তু গ্রীষ্মকালেই বেশি ছড়িয়েছিল। এছাড়াও ২০০৩ সালে সার্সের প্রাদুর্ভাব শীত এবং গরম দুই আবহাওয়াতেই ছিল। মসৃণ পৃষ্ঠের উপর সার্স ভাইরাস পাঁচ দিনেরও বেশি সময় ধরে ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এবং ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতার মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছে।
মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের যেসব বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলগুলোতে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে সেখানকার গড় তাপমাত্রা প্রায় ৫ থেকে ১১ সেন্টিগ্রেড বা ৪১ থেকে ৫২ ফারেনহাইট এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম ছিল। চীনের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় জানা গেছে, কোভিড-১৯ কতটা মারাত্মক হতে পারে এবং আবহাওয়ার পরিস্থিতির তারতম্যে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
যেদিন চীনের উহান শহরে মৃতের সংখ্যা ২৩০০ হয়েছিল। সেদিন তারা দেশের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং দূষণের মাত্রা পরীক্ষা করেছিলেন। যদিও এই গবেষণাটি এখনো একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, যে দিনগুলোতে আর্দ্রতার মাত্রা এবং তাপমাত্রা বেশি ছিল তখন মৃত্যুর হার কম ছিল।
ফ্রান্স ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড মেডিকেল রিসার্চ এর পরিচালক ডিরেক্টর ভিটোরিয়া কলিজ্জা বলেছেন, কোভিড-১৯ আবহাওয়ার প্রভাবে আচরণ পরিবর্তন করছে এমন কোনো তথ্য এখনো জানা যায়নি। তবে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এই ভাইরাসটি দমন করার একমাত্র উপায় হলো প্রথমে নিজেকে একটি ঘরে আবদ্ধ করতে হবে অর্থাৎ লকডাউন। নিজে থেকেই যারা এই উপায় অবলম্বন করেছেন তাদের অনেকেই আজ করোনাভাইরাসকে জয় করতে পেরেছেন।
তিনি আরো জানান, এয়ার ট্রাভেলই মূল পথ ছিল যার মাধ্যমে এই ভাইরাসটি এত তাড়াতাড়ি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আরো আগে যোগাযোগ বন্ধ এবং লগডাউন করতে পারলে এ মহামারি ছড়ানো রোধ করা যেত।
কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে আবহাওয়ার তেমন কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তাই গ্রীষ্মকালেও এটি পুরোপুরি অদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কয়েকজন বিশেষঞ্জদের এমনই মত।