উপজেলায় নতুন তখন। সবাইকে ঠিকঠাক চিনিও না। হঠাৎ একদিন আমার রুমে পেট মোটা এক হোৎকা লোকের আগমন। হাতে বেশ কিছু কাগজ। আমার সামনে সেগুলো ফেলে বেশ ভাব নিয়ে বললো, ‘আরএমও স্যার এখনো আসে নাই, তাই এই কাগজগুলায় আপনার সাইন লাগবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে আপনি, নাম কি আপনার?’ উত্তরে, ‘আমি এম্বুলেন্সের ড্রাইভার, শাহজাহান!’
কাগজগুলো হাতে নিয়ে দেখলাম পাম্পে তেল নেওয়ার কাগজ। আমি তাকে বললাম, ‘আমি তো এসব কাগজের কিছু বুঝি না, নতুন আসছি। আর তারপরেও যদি সাইন করতে হয় তবে আপনার গাড়ির কি. মি. রেজিস্টার লাগবে।’
আমার কথা শুনে সে সম্রাট শাহজাহানের মত বাজখাই গলায় হাঁক দিয়ে বলে উঠলো, ‘ওসব কিচ্ছু লাগে না, সব স্যাররা সাইন করে, আপনিও সাইন করবেন!’
আমি তাকে আস্তে কথা বলতে বললাম। ভদ্রভাবে বললাম ‘দেখেন, সব স্যাররা করলেও আমার পক্ষে সম্ভব না, আমি নতুন আসছি বুঝতেই পারছেন। প্রয়োজনে আপনি অপেক্ষা করেন। আরএমও স্যার কিছুক্ষণ পরেই আসবেন, সাইনটা তার কাছ থেকেই নেন!’ উনি বললেন, ‘না, এখনই লাগবে!’
আমি ওনার কথার রিপ্লাই না দিয়ে চুপচাপ রোগী দেখতে থাকলাম। উনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেশ ঝাঁজালো কন্ঠে উচ্চবাচ্য শুরু করলেন, তারপর রাগে গোৎ গোৎ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আরএমও আসলে আমি তাকে বিষয়টা ইনফর্ম করলাম। তাকেসহ আমরা দু’জনে স্যারকে তার বাজে ব্যবহারের বিষয়টা জানালাম, স্যার শাহজাহানকে ডেকে কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন।
শাহজাহান মনে করলো আমি তার শত্রু। রয়ে সয়ে মেনে নিয়ে থাকার বিষয়টা আমার মধ্যে কম। কোন কিছু অন্যায় মনে হলে প্রতিবাদ আমি সরাসরিই করি, তাতে যে কেউ আমার শত্রু হোক না কেন। তো সেদিন থেকে শাহজাহান কোনদিন আর আমার সাথে কথা বলেনি, তবে আমার সম্পর্কে সুযোগ পেলেই বাইরে কথা বলেছে, যা খুশি তাই বলেছে!
তো আসুন এবার এই সম্রাট শাহজাহানের মহান সাম্রাজ্যের কিছু গল্প শুনি। যদিও পেশায় তিনি এম্বুলেন্সে ড্রাইভার, তথাপি তার সম্পদ দু’চার অফিসারকে হার মানায়। উপজেলায় কয়েকতলা বাড়ি, বিস্তর জমিজমা, ব্যবসা, আরো অনেক কিছু, ছেলেমেয়েরা ঢাকায় পড়ে প্রাইভেট মেডিকেল ভার্সিটিতে। এত টাকা কোত্থেকে আসে?
প্রতিমাসে ড্রাইভার শাহজাহান তার গাড়ির তেলখরচ ও মেইন্টেনেন্স বাবদ প্রচুর সরকারী টাকা উত্তোলন করে। কিন্তু রোগীদের কাছ থেকে যা পথভাড়া রাখে তার ডাবল! এই যেমন উপজেলা থেকে খুলনার ভাড়া দুই হাজার, সে নেয় চার হাজার! রোগীও নিরুপায়, না দিয়েও উপায় নাই। তবে তার একটা ভাল দিক হল, যেহেতু উপজেলাতেই বাড়ি তাই তাকে রাতবিরেতে যে কোন সময় পাওয়া যায়! পাওয়া যাবেই বা না কেন, ট্রিপ মারলেই তো লাভ! শুধু তাই না।
আমি যদি রেফার করার পর রোগীর লোককে বলি ‘রোগী নিবেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।’ কিন্তু শাহজাহান রোগী নিয়ে প্রবেশ করে খুলনা মেডিকেলের সামনে ‘সাউথ জোন’ হাসপাতালে। যে হাসপাতালের চিকিৎসার ধরণ এমনই যে তারা CT scan of brain কে একবার লিখেছিল CT skin of brin. সেও ইতিহাস, যার প্রমাণও আছে আমার কাছে। তো সেই ক্লিনিকে রোগী নিয়েই শাহজাহান তার বহু বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ অভিনয় শুরু করে।
টিকেট কাউন্টারে গিয়ে খুব দায়িত্ব নিয়ে বলে, ‘আমার রোগী, টিকেটের টাকা কম রাখেন, ৫০০ টাকার জায়গায় ৩০০ টাকা রাখেন!’ এরপর রোগীকে বলে, ‘দেখছেন, কত ভাল জায়গায় নিয়ে আসছি, টাকা কমানো শুরু করে দিছি। বিভিন্ন জায়গায় বলে দিচ্ছি, চিকিৎসার টাকাও একদম কম রাখবে!’ এভাবে চলতে থাকে শাহজাহানের খেলা! কমিশন বাণিজ্যে ভরে শাহজানের পকেট, আর রোগী হয় কর্পদকশূন্য।
এমনও দেখা যায়, রোগী সেখানে টাকা পয়সা খুইয়ে, ভাল না হয়ে পরে শেষ সময়ে যেয়ে হাজির হয় মেডিকেল কলেজে। এই ঘটনা জানার পর রোগী রেফার করলেই আমি লোকদের সাবধান করে বলি, ‘শাহজাহান কিন্তু ক্লিনিকে নিয়ে পার্সেন্টেজ খাবে, চিকিৎসাও ভাল হবে না। তাই রোগী নিয়ে সোজা আড়াইশো বেড হসপিটালে যাবেন, অন্য কোথাও না। শাহজাহান উলটাপালটা বুঝাইলেও না। শাহজাহান এসব শুনে আবার মনে করলো আমি শুধু তার শত্রুই না, বড় শত্রু!
কিছুদিন পর শুনলাম, শাহজাহানের চাকরি প্রায় শেষের দিকে। অল্প ক’দিন পরই রিটায়ার করবে। আমি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম। যাক বাবা এবার তাহলে এই খারাপ লোকটার সংস্পর্শ থেকে বাঁচা যাবে, বাঁচবে রোগীরাও। কিন্তু আমার সব চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে গড়ে উঠলো শাহজাহানের নতুন তাজমহল, সে এক ইতিহাস।
যেদিন শাহজাহান রিটায়ার করলো তার পরদিনই নতুন ড্রাইভার এল। কিন্তু মাথায় বাঁজ পড়ার মত খবর দিল সে, এম্বুলেন্স নাকি চলেনা। নতুন ড্রাইভার জানালেন, ‘গাড়ির এই সমস্যা, সেই সমস্যা। বিভিন্ন পার্টস পাতি নাই, ঠিক করা অনেক টাকার ব্যাপার। উপরে জানানো হইছে, দেখা যাক কবে বরাদ্ধ আসে।’ ঠিক দুদিন আগেও যে এম্বুলেন্স চলেছে, আর আজ তার এই দূর্দশা।
আমি চিন্তা করে কোন কূল পাইনা। তবে ক্লু যেটা পাই সেটা হল সম্রাট শহজাহান পুরাতন সম্রাজ্য ত্যাগ করার পূর্বে যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে তার বারটা বাজিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু সে কেন এটা করলো সেটা জানতে আমার দু’দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। এক দিনের মাথায় দেখি হাসপাতাল চত্বরে ঝাঁ চকচকে নতুন এম্বুলেন্স। এর মালিক কে? কে আবার, সেই সম্রাট শাহজাহান।
সরকারী সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যু হয়েছিল। ভেবেছিলাম প্রজারা এবার মুক্তি পেল, মুক্তি পেলাম আমি। কিন্তু শাহজাহানের প্রেতাত্মা যে এভাবে আবার আবির্ভূত হবে তা আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। উপজেলা সাম্রাজ্যে এই সব শাহজাহানরা যুগে যুগে সম্রাটগিরি করে যাচ্ছে, হয়তো করবে ভবিষ্যতেও। তাদের কাছে আমাদের মত ক্যাডার ডাক্তার কোথাকার কোন নচ্ছার! তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চললে ‘বড় ডাক্তার’, আর বিরুদ্ধাচারণ করলে, ‘আরে ও কোনো ডাক্তার…!!
লেখক: সহকারী সার্জন
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।