জহিরুল কাইউম ফিরোজ:
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে সেটা জানতে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর আর কোন দেশে বোধকরি অনুজীবটি এত অবাধে বিচরণ করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সে যখন মৃত্যুর দামামা প্রতি ন্যানোসেকেন্ডে বাজছে আমরা তখন গা জোয়ারি ভাব নিয়ে বলছি- ‘করোনা? এ আবার কোন ক্ষেতের মুলা!’ দূর্ভাগ্যবশত আমরা জানি, কিন্তু মানি না। ফলাফল চোখের সামনেই। মালদ্বীপ, ভিয়েতনামের মতো ছোট দেশ করোনাকে সামাল দিয়েছে ভালভাবে। যুদ্ধ অধ্যুষিত গাজা উপত্যকা রীতিমত আটকে দিয়েছে করোনাকে। সেখানে একজনও রোগী নেই। তাদের সম্মিলিত ভাষ্য হচ্ছে, ‘আমরা অনুন্নত। এটি আমাদের এখানে এলে আমরা ঠেকাতে পারব না। আমাদের স্বাস্থ্যখাতের সেই সাধ্য নেই। তাই আমরা প্রতিরোধে বিশ্বাসী।’
বাংলাদেশ প্রতিরোধ, প্রতিকার কিছুতেই বিশ্বাসী নয়। আমরা এক এবং একমাত্র ফাঁকা বুলিতে আস্থাশীল। সেসবের মাশুল গুণছি। গুণে যাব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিবিসি এরা বলেছে বাংলাদেশ সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে আছে। সেই ঝুঁকির হার কমাতে যদি কেউ পারে, তা হচ্ছে ডাক্তার। আমরা ডাক্তারদের কসাই, ব্যবসায়ী বলি। তা তাদের অনেকে আদতে কসাই’ই। কিন্তু করোনার সময়ে তারা আর যা’ই করুক, কসাইগিরি করছে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসছে। তাহলে আজকের দিনের জন্য তাদের গতকালকে ভোলা যায় না?
ডা. মইন উদ্দীন আহমেদ মারা গেলেন। অমনি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বলতে স্রেফ সরকার নয়, জণগণকেও বোঝায়। আমজনতা তাকে করোনা যোদ্ধা আখ্যা দিয়েছে। বীরের খেতাব দিচ্ছে। এসব খেতাব তাকে ফেরাতে পারবে? পারবে না। তেমনি ডা. মইনের মৃত্যুর দায় এড়ানোও অসম্ভব। তিনি সুরক্ষা চেয়েছিলেন, আকুতি করেছেন, পাননি।
আবার একদল বলছে, তিনি ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়নকালে শিবির নেতা ছিলেন। কেউ বলছেন, উনি চেম্বারে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ছাড়াই রোগী দেখেছেন। দলীয় পরিচয় টেনে আনাটা মূর্খামি, অজ্ঞতা। উইডাউট প্রটেকশন রোগী দেখার কথা যারা বলছে, তারা ভুলে গেছে ডা. মইন সুরক্ষা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে পরপারেই পাড়ি জমালো।
শুধু চিকিৎসকদের বাহবা দিলে নার্স, ওয়ার্ডকর্মীদের প্রতি চূড়ান্ত অবিচার হবে। তাদেরও পর্যাপ্ত সুরক্ষার প্রয়োজন। কেননা ডাক্তারের চাইতে রোগীর সান্নিধ্যে তারা বেশি থাকেন। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, যেখানে বাংলাদেশের সবচাইতে বেশি করোনা আক্রান্ত কিংবা সম্ভাব্য রোগী ভর্তি। এখানেই প্রথম করোনা আক্রান্তদের সেবাদান শুরু হয়। সেখানে কিছুদিন আগে কর্মরত চিকিৎসক নার্সদের খাবার দেওয়া নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন খাবার সরবরাহ করে। সেখানকার এক নার্স এরচেয়েও ভয়ানক তথ্য দেন। প্রথম দিকে তাদেরকে পিপিইর পুরো সেট দেওয়া হলেও এখন কেবল গাউন দেওয়া হয়। শু কভার, স্পেশাল গ্লাস, হেড ক্যাপ এসবের আশা করা তো ঘোর বিলাসিতা! মাস্কের কাটতি বলে দায় এড়াচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নার্সেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রহণ করেছে রোটেশন পদ্ধতি। রোগীর কাছাকাছি একদিন তিনজন করে যাবে। ওই তিনজন পিপিই পড়বে, বাকীরা নার্সিং ইউনিটে দায়িত্ব সামলাবে! পিপিই ওয়ান টাইম ইউজেবল। অথচ সেটি ধুয়ে শুকিয়ে পরেরদিন পড়ছেন তারা। ডাক্তাররা খুব ভালো আছে তা ভাববার অবকাশ নেই। ডাক্তাররাও পিপিই ধুয়েই পড়ছেন। উপায় নেই।
স্রষ্টার পর মানুষকে বাঁচানোর ক্ষমতা থাকলে সেটি ডাক্তারদের। করোনায় বিশ্বব্যাপী সেবকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবি দেখলে মায়া লাগে। চোখের নিচে কালি, নাকের দু পাশ দেবে যাওয়া, কপালে রক্তজমাট বাঁধা! পরিবারের কাছে এরা ফিরতে পারবে কি না কেউ জানেন না। আমরা তাদের জন্য কী করছি? কতটা সাহায্য করছি? বলতে পারেন, সাধারণ মানুষ তো আর ডাক্তারি করতে পারবে না। মানছি। কিন্তু যা করতে পারি তা কী করছি?
ময়মনসিংহের একটি হাসপাতালের গোটা একটা ওয়ার্ড ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজন ডাক্তার ঝুঁকিতে আছেন। সেখানে আসা এক রোগী উপসর্গ লুকিয়ে সাধারণ পেশেন্ট হিসেবে আসাতে এহেন অবস্থার সৃষ্টি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়া ডাক্তার হামিদা মুস্তফা এলাকা ছাড়া হন!
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসেসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কভিড-১৯ পজিটিভ নার্সের সংখ্যা ১১। বেসরকারি হাসপাতালে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩। এটা প্রতিদিনই বাড়বে। আইডিসিআরের মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, তিনিও আইসোলেশনে। ধারণা করা হচ্ছে, আইডিসিআরের চারজন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত।
পৃথিবী থমকে গেছে ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের প্রকোপে। অফিশিয়ালি দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ আক্রান্ত, মৃতের সংখ্যা দেড় লাখ ছুঁতে বেশি সময় লাগবে না। ইকুয়েডরের গুয়াকুইল শহর মর্গে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় পঁচেগলে গন্ধ ছড়াচ্ছে লাশ। ইতালি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থা শোচনীয়। আর্তনাদের ক্রমশ ভারী হচ্ছে পৃথিবীর বাতাস। বাংলাদেশে রোজ রোজ বাড়ছে রোগী, বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। সর্বশেষ হিসাবে মোট ১৫৭২ জন আক্রান্ত, মৃত ৬০। মৃত্যুহার ৩.৮২%। রেকর্ড ভাঙ্গছে প্রতিদিন।
উত্তরণের পথ কেবল সচেতনতা। ঘরে থাকা। আরো একটা পথ আছে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সঠিক তথ্য দেওয়া। আর রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে ডাক্তারদের পর্যাপ্ত সুবিধা ও কর্মপরিবেশ দেওয়া। এমনিতেই মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে গেছে। ডাক্তাররা আক্রান্ত হলে দেখার কেউ থাকবে না। তখন তাদের করোনা যোদ্ধা ট্যাগ দেবার জন্য রাষ্ট্র থাকবে। বিভাজিত হওয়ার জন্য যে মানুষ প্রয়োজন, সেই মানুষবিহীন রাষ্ট্র।