এম এস দোহা:
করোনায় কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ। যা অনেকটা ঘর পোড়ার মধ্যে আলুুপোড়ার মতই। এই মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাতে অনেকই ঘাপটি মেরে প্রতীক্ষায় থাকে। নচেৎ ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার সুযোগ হাত ছাড়া হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নিজের আখের গুছানোর কর্মযজ্ঞের প্রতিযোগিতা। এটা মনে হয় শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ। পরাশক্তিধর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশেও এর প্রভাব বিদ্যমান। চীনের উত্তান যেমন আমেরিকার জন্য হুমকি। রিলিফ চোরেরা বর্তমান বাংলাদেশের জন্য জন্য মাথা ব্যথা।
উল্লেখ্য, করোনাকে পুঁজি করে পৃথিবীর সম্ভাব্য সুপার পাওয়ারের শীর্ষের পৌছার দ্বার প্রান্তে চীন। দেশটির জন্য মনে হয় করোনা পৌষ মাস বা আর্শীবাদ স্বরূপ। চীন থেকে করোনা সুত্রপাত হলেও এখন পরিস্থিতি দেশটির পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণে। ভাইরাসটি মোকাবেলায় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন নাস্তানাবুদ, চীন তখন ব্যস্ত ব্যবসা বানিজ্য ও শেয়ার বাজার দখলে। বলতে গেলে তারা পুরোপুরি সফলও। করোনা বিষয়ক চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশটির অর্থনীতি। বিশ্বের স্টক মার্কেটের প্রায় অর্ধেক শেয়ার এই সুযোগে চলে এসেছে দেশটির নিয়ন্ত্রণে। অস্ত্র ও ক্ষেপনাস্ত্রে এখন তাদের মনোযোগ নেই। করোনা ভাইরাসের মরোনাস্ত্রকে পুজি করে তারা ঝুকে পড়েছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বানিজ্যে। কারণ পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণে আগামীতে অস্ত্র নয়, স্বাস্থ্য-ই থাকবে শীর্ষে।
সুপার পাওয়ার খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইটালী, ফ্রান্স, জার্মানীসহ বিশ্বের ২০৯ দেশের সরকার প্রধান হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন এটম বোমার চেয়ে করোনা ভাইরাস কতটা ভয়াবহ। যার ছোবলে থেকে রক্ষা পায়নি বৃটেনের রাণী থেকে শুরু করে সৌদি রাজ পরিবারের সদস্যরাও। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ঝুকি মোকাবেলায় কোরারেনটাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, লক আউট ও বাঙ্গালীর বাঁশের বেড়ায় অনেকেরই অর্থনৈতিক সর্বনাশ।
অপ্রিয় হলেও সত্য, ধনী রাষ্ট্রগুলোকে ছাড় না দিলেও গরিব হিসাবে বাংলাদেশকে করোনা যথেষ্ট সহানুভূতি দেখিয়েছে। কিন্তু আমরা তা কাজে লাগাতে পারি নি। দুই মাস পূর্বে চীনে আটকা পড়া বাংলাদেশীদের দেশে ফেরাতে আমরা ছিলাম উদগ্রীব। কিন্তু বাঁধসাধে বেইজিং। হোমকোয়ারেন্টাইন ছাড়া কাউকে আসতে না দিয়ে বাপের দায়িত্ব পালন করেছে তারা। যা এখন আমাদের উপলদ্ধি হচ্ছে।
আমেরিকাÑইউরোপে হামলার ভয়াবহতা থেকে বিগত তিন মাসে আমাদের অনেক কিছু শেখার ছিল। কিন্তু আমরা পাত্তাই দেইনি। সব ঠিক আছে! করোনা আমাদের কিছুই করতে পারবে না! উন্নত বিশ্বের চেয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা এগিয়ে! আরো কত কি! করোনা রোগী সনাক্তের দেড়মাস পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ১৯ এপ্রিল ১৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রয়োজনীয়তা মনে করে। বাহ! কি চমৎকার। এতদিনে মন্ত্রীবাহাদুরের ঘুম ভাঙ্গলো! প্রাইভেট হাসপাতাল গুলো দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিলেও এই সংকটে তাদের বসানো হয়েছে ভিলেনের চরিত্রে। নায়কের ভূমিকায় মন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সিলেটের ডাঃ মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর পর আমরা নতুন ভাবে পরিচিত হলাম করোনা চিকিৎসায় সক্ষমতার দৌড় সম্পর্কে। সর্বনাশের বিষয়, আরো ৩২৪জন চিকিৎসক ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত। যা চিকিৎসকদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবের জন্মদেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্যতম ঠিকাদার জেএমআই গ্রুপ চিকিৎসকদের অন্যতম সুরক্ষা সামগ্রী ২০৬০০টি এন৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে। যা ছিলো নকল। চিকিৎসকদের আপত্তির পর বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নাকি জামাতপন্থি। বেচারা নকল মাস্ক সরবরাহের মাধ্যমে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের স্বপ্ন দেখেন। ১৯এপ্রিল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভূলবসত এন৯৫ মাস্কের র্কাটুনে ‘ফেইস মাস্ক’ ঢুকানো হয়। বাহ! কি চমৎকার যুক্তি! কিন্তু এর মধ্যে যা সর্বনাশ হওয়ার তা সুসম্পন্ন। এই নকল মাস্ক ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে প্রশ্ন উত্তাপন করায় ১০জন চিকিৎসক এখন বেকায়দায় তাদের দেওয়া হয়েছে কারণ দর্শানো নোটিশ। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এটিম মঞ্জুর মোর্শেদ কে বদলী করা হয়েছে পাবনা মানসিক হাসপাতালে। হয়রানি ভয়ে এখন আর এনিয়ে অনেকই মুখ খুলতে নারাজ।
চলামান করোনা সংকটকে পুঁজি করে জেএমআই গ্রুপের মতো অনেকেই ব্যবসা বানিজ্যে পোয়া বারো। ইতিমধ্যে বাইশ কোটি টাকার হিসাব মিলাতে পারছেনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হয়তো অন্তরালে আরো অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপও এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে নারাজ। দু’ হাজার শয্যার হাসপাতাল বানিয়ে সরকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণে তারা মরিয়া। ব্যবসা-বানিজ্যে সর্বক্ষেত্রেই তাদের আধিপাত্য। সুতারাং এখাতে পিছিয়ে থাকবে কেন? দেখা যাক চিকিৎসকসহ দক্ষ জনবলের ব্যপারটি তারা কিভাবে সামাল দেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এখন ইতিহাসের কাঠগড়ায়। তার আশাব্যঞ্জক হবে, হচ্ছে, আছে স্লোগানের কথা জাতী চিরদিন স্মরণ রাখবে। সচিব আসাদুল ইসলাম নতুনভাবে পরিচিতি হলেন বিএনপি’র আমলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. মোশারফের পিএস হিসেবে। মহাপরিচালক ডাঃ আবুল কালাম ঢামেক এর শিবির নেতা হিসেবে হন চিহ্নিত। বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী গার্মেন্টস খোলা রাখার ম্যারপ্যাচে পড়ে এখন দারুন বেকায়দায়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম রিলিফ চোরদের বিরুদ্ধে ষাড়াসি অভিযান চালিয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তির দাবীদার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিভিন্ন জাতীয় দূযোর্গ সাধারণ মানুষের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনলেও একশ্রেনীর জনপ্রতিনিধি, চেয়ারম্যান, মেম্বার এরজন্য থাকেন প্রতিক্ষায়। তারা খাপটি মেরে অপেক্ষা করে, কখন ত্রাণ আসবে। রিলিফ থেকে দু’চার পয়সা না কামালে কি হয়! করোনা সংকটে অনেকেই মোচে তা দেন। পুকুরে, মাটির নীচে, খাটের তলে পাওয়া যায় ত্রাণ। ৭৪ সালের স্টাইলে অনেকে হরিলুটের স্বপ্ন বিভোর। এদেয় হুশিয়ারী দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার ধারাবাহিকতায় ইতিবাচক প্রদক্ষেপ নিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। চুরি ও অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান মেম্বারকে চিহ্নিত ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের মনিটরিং নিজেই করেন। বরখাস্তের সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন ধারাবাহিকভাবে। সেই সাথে চলছে পুলিশের হাতকড়া, গ্রেফতার, ধরপাকড়। ফলে নড়েচড়ে বসেছেন সুযোগসন্ধানী দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান, মেম্বারগণ। ইজ্জত ও হয়রানীভয়ে অনেকেই এখন স্বচ্ছতা পরিদর্শনের প্রতিযোগিতায়। যা চলমান করোনা সংকটে তৃণমূলে সুষ্টভাবে ত্রাণ বিলি-বন্টনে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপও বটে। আবার অস্বীকার করার উপায় নাই যে, অধিকাংশ চেয়ারম্যান, মেম্বার, সরকারের পাশাপাশী নিজের অর্থে ত্রাণ দিচ্ছেন। রাত দিন করছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। গুটি কয়েক রিলিফ চোরের জন্য তাদের ভাল কাজ গুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এসব জন প্রতিনিধিদের ভাল কাজের স্পৃহায়।
উল্লেখ্য, দেশের প্রায় ৬৫ হাজার জনপ্রতিনিধি রয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। করোনা সংকটে তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণ বিলি-বন্টনে এসব জন প্রতিনিধিদের ভূমিকা অপরিসীম। ফলে জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি সরকারও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি।