সৌমিত্র শেখর: উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে যদিও উত্তপ্ত পরিপার্শ্ব, তবুও এ কথা না-মেনে উপায় নেই, আধুনিকতার সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞার্থ প্রদান করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু আধুনিকতার পাশাপাশি উত্তর-আধুনিকতা আজ বহুল চর্চিত বিষয়- এ-ও মিথ্যে নয়। রোম্যান্টিকতা আধুনিকতার একটি বৈশিষ্ট্য। উত্তর-আধুনিকতাও একে অস্বীকার করে না। অথচ এই ‘রোম্যান্টিকতা’ও রয়ে গেছে অব্যাখ্যাত; শুধু মানুষের বোধের সীমানায় এর অধিবাস। অবশ্য এর কতিপয় লক্ষণ করা গেছে নির্দিষ্ট; যে-সব দিয়ে রোম্যান্টিকতার মৌলচিহ্নগুলোর পরিচয় লাভ হয়তো সম্ভব। এগুলোর মধ্যে সূক্ষ্মতর রহস্যবোধের চেতনা, মননশীলতার অর্গল-মুক্তি আর জীবনযাপনে সহজ সারল্যের প্রতি অমিত আকর্ষণকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ফলে, কোনো লেখকের লেখনী বা শিল্পীর তুলিতে রোম্যান্টিকতার প্রকাশ বলতে, শুধুই মানবীয় প্রেমজ কতিপয় আচরণে তা যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, সে-কথা বাহুল্যই লেখা। বরং রোম্যান্টিকতার বৃহত্তর সীমারেখায় ঐ শিল্পী বা রচয়িতার দেশ-কাল সচেতনতা, প্রতিবাদ-সংগ্রামচৈতন্য ইত্যাদি জীবনযুদ্ধের অপরিহার্য বিষয়গুলোও তাতে অন্তর্ভুক্ত হয় অনিবার্যভাবে।
কাজী নজরুল ইসলামের কবি-স্বভাব কিন্তু রোম্যান্টিকতার বিচিত্র উপাদানে সৃষ্টি। কবির কাব্যচেতনায় যে প্রণয়স্পর্শ কিংবা রহস্যবোধের ছোঁয়া, প্রকৃতির বিচিত্র আবেশে তাঁর যে আত্মলীনতা অথচ কোথাও আবেগের তীব্রতা, অনুভূতির তীক্ষ্মতা, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ- এসবই বোধ করি কবির চরম রোম্যান্টিকতার প্রকাশ। শুধু তাই নয়, কবির মধ্যে যে বেদনা, যন্ত্রণা এমন কি কখনো চরম নৈরাশ্য দেখা যায় তা-ও তাঁর রোম্যান্টিক মনের অবদমিত চেতনা-প্রবাহ বলেই মনে হয়। সমালোচকরা যেমন রোম্যান্টিকতার লক্ষণ নির্দেশ করেছেন, মনস্তাত্ত্বিকগণ রোম্যান্টিক মানসিকতার দ্বিবিধ প্রকাশের কথা বলেছেন। নন্দনতাত্ত্বিক চেতনা, প্রণয়ীর আকর্ষণ ইত্যাদির জন্যে চরম আকাঙ্ক্ষা এবং এর ব্যর্থতায় হতাশা-অনুতাপ-যন্ত্রণা; ফলে অলীক স্বপ্নবাসর রচনা- এর একটি। অন্যটি হচ্ছে, এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অদৃষ্টবাদী না হয়ে দুর্জয় সংগ্রাম, বিদ্রোহ অর্থাৎ প্রার্থিত বিষয় ‘আদায়’ করে নেবার মানসিকতা। সাহিত্যেও এই মনস্তাত্ত্বিক সত্যাসত্যের প্রতিফলন দেখা যায়। হুইটম্যান, শেলি, বায়রন, নাজিম হিকমত, নজরুল ইসলাম প্রমুখ, এ বিচারে- প্রায় সমগোত্রীয়। কেননা, এঁরা যেখানে বিদ্রোহী বা প্রথাবিরোধী সেখানে এঁদের প্রেরণার শিকড় এই রোম্যান্টিকতা তথা জীবনাগ্রহ, আবেগ-প্রবণতা ও তীক্ষ্ম জীবনানুভূতির গভীরে প্রোথিত। এঁদের সবার মধ্যেই রোম্যান্টিকতার অন্যতম লক্ষণ জীবনযাপনে সহজাত সারল্যের প্রতি অমিত আকর্ষণ বিশেষভাবেই লক্ষযোগ্য। হুইটম্যানের সাম্যবাদী জীবনবোধ বা উন্মুক্ত জীবনাকাঙ্ক্ষা অথবা ইমার্সেনের সূক্ষ্মতম পর্যায়ে জীবনকে উপলব্ধির প্রচেষ্টা কিংবা নজরুলের ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ও কুলি-মজুর-বারাঙ্গনাদের মধ্যে জীবন খুঁজে নেয়া- এ সমস্ত রোম্যান্টিকতারই প্রকাশ।
বায়রনের মতো কাজী নজরুলের দেশ-কালও তাঁর রোম্যান্টিক-মানসকে সমকালীন উপাদানে রূপায়িত করে বিচিত্র সংশ্লেষ দান করেছে। বায়রন প্রভু আর ভৃত্যের মধ্যে পার্থক্য থাকুক তা চান না; নজরুলও গোলামির চেয়ে ‘শহীদী দর্জা’ শ্রেয়তর মনে করেন। হুইটম্যান যেমন তাঁর ‘লিভস্ অফ গ্রাস’ কাব্যগ্রন্থে দেশ-সত্তার প্রতি সচেতন হয়ে রোম্যান্টিক; নজরুলও তেমনি তাঁর অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙার গান, সর্বহারা ইত্যাদি কাব্যগ্রান্থে দেশ-সত্তা, মানব-সত্তা ও আত্ম-সত্তার প্রতি সচেতন হয়ে রোম্যান্টিক। তাই হুইটম্যানের ‘I am satisfied, I see, dance. laugh. sing’- এই পঙ্ক্তির মতো নজরুলও ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উচ্চারণ করতে পারেন:
‘আমি নৃত্য পাগল-ছন্দ
আমি আপনার তালে নেচে যাই-আমি মুক্ত জীবনানন্দ।’
প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামকরণেই যেন ঊষরতা আর পেলবতার মিশ্রণ- ‘অগ্নি-বীণা’। আগুন আর বীণার কোমনীয় সুরমিশ্রণের কি চমৎকার নিদর্শন! স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নি-বীণা বাজাও তুমি কেমন করে’ গানে এই শব্দবন্ধের ব্যবহার প্রথম লক্ষ করা যায়। কিন্তু এই শব্দবন্ধটি নজরুলের হাতেই লোকপ্রিয় হয়েছে এবং তা আসলে নজরুলেরই হয়ে গেছে যেন! এই কবি এক সময় নিজেকে ‘বর্তমানের কবি’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। বর্তমানকে অঙ্গীভূত করা তথা সমকালীন দেশ-কালকে আত্তীকরণ তাঁর মধ্যে শুরু হয়েছিল প্রথম থেকেই। আর এই আত্তীকরণের মধ্য দিয়েই তিনি ‘মেজর পোয়েট’ হিসেবে আবির্ভূত হন- যেমন, লুই আরগঁ, পল এলুয়ার কিংবা পাবলো নেরুদা অথবা বাংলা সাহিত্যে পরবর্তীকালে বিষ্ণু দে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নামকরণেই শুধু নয়, বিষয় বিন্যাসেও নজরুল অতি-রোম্যান্টিক। ‘দোলন-চাঁপা’! এই নামের মধ্যেই আবিষ্কার করা সম্ভব একটি অতি-আবেগী সেন্টিমেন্ট। এখানে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক অধিবাস বুদ্ধিতে নয়, কল্পনার বোধিতে। আশালতা সেনগুপ্তার ডাকনাম ছিল দোলন। নজরুল-আশালতার প্রেমপর্যায়ের আবেগ এই গ্রন্থে অপ্রকাশ্য নয়। এতো গেলো তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ নিয়ে চুম্বক-কথন। কিন্তু ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে খ্যাত নজরুল ইসলামের বিদ্রোহীভাবের আদি ধারক বলে কথিত অগ্নি-বীণাতেও কিন্তু নজরুল আমাদের পূর্ব-শনাক্তকৃত লক্ষণ অনুযায়ী রোম্যান্টিক। যে কবিতায় কবি ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ উঠতে চান কিংবা বিদ্রোহী ভৃগু মুনির মতো বলতে পারেন:
‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!’
সে কবিই আবার যখন একই কবিতায় উচ্চারণ করেন:
‘আমি চির-শিশু, চির-কিশোর
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!’
তখন পাঠক-সমালোচক প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মিল খুঁজে পান না। আসলে কবিচিত্তে সংগ্রাম ও প্রেমানুভূতির মহামিলন না ঘটলে কবি এতো রোম্যান্টিক হতে পারেন না। অনেকে ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সঙ অফ মাইসেলফ্’ কবিতার পাশাপাশি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রেখে পড়তে আপত্তি করেন। কিন্তু কবিতা দুটোতে দুই কবি-মানসের যে রোম্যান্টিক আত্মসত্তার জাগরণ লক্ষ করা যায় তা কিন্তু বিশেষ তাৎপর্যময়।
অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থে ‘ধূমকেতু’ কবিতায় কবির ঘোষণা:
‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
আমি এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।’
এই ঘোষণার পরও এ কাব্যে কবি প্রেমকে পরিত্যাগ করতে পারেন নি পুরোপুরি। কাব্যগ্রন্থটির উৎসর্গ-কবিতা স্বদেশী আন্দোলনের একজন বিপ্লবীর উদ্দেশে; কিন্তু এখানেও কবির রোম্যান্টিক মন অপ্রকাশিত থাকে নি। সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষকে তিনি লেখেছেন:
‘বজ্রে তোমার বাজল বাঁশী
বহ্নি হল কান্না-হাসি
সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী-
মন সরে না কাজে।’
এই গ্রন্থেই কবি প্রলয়োল্লাসী। যে প্রলয় সংকীর্ণতাকে ধ্বংস করে নতুন ও সুন্দরকে সৃষ্টি করে নজরুলের রোম্যান্টিক মন তার উদ্গাতা। আর তাই ‘প্রয়োল্লাস’ কবিতায় তাঁর ঘোষণা:
‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?- প্রলয়নূতনসৃজন-বেদন!
আসছে নবীন- জীবন-হারা অসুন্দরের করতে ছেদন!’
‘কামাল পাশা’ কবিতাতে অনেকে ‘মুসলিম জাগরণের তত্ত্ব’ আবিষ্কার করলেও আসলে কবি ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের স্থপতি কামাল আতাতুর্ককে নৈতিকভাবে সমর্থন জ্ঞাপন করে রচনা করেছেন এ কবিতাটি। কবিতায় ‘কামাল পাশা’র বিজয়ে উদ্বেলিত কবি নারীদের অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত করেছেন সৈনিকদের মধ্যে। নারীরা অভিবাদন জানাবার সময় ধর্মান্ধতার প্রতীক নেকাব খুলে ফেলেছে- বন্ধন করেছে ছিন্ন। কবি তাই উল্লেখ করেছেন: ‘আজ বধূদের মুখের বোরকা খসিয়া পড়িয়াছে। ফুল ছড়াইয়া হাত-দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতেছিল। সৈন্যগণ চীৎকার করিয়া উঠিল!’ তারপরই ‘কামাল পাশা’ কবিতায় কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়:
‘মরণ-বধূর লাল রাঙা বর? ঘুমো!
আহা, এমন চাঁদ মুখে তোর কেউ দিল না চুমো।’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা বা অন্ধ সংস্কার নয়, রোম্যান্টিকতা জীবনঘনিষ্ঠতায় উঠে এসেছে এখানে- নজরুলের সৃষ্টিতে।
নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী কবি’ এই আপ্তবিশেষণটির বিপ্রতীপে লক্ষ করা যায়, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নি-বীণাতেই বিষয় ও শৈলী উভয় ক্ষেত্রে এখানে বহুমাত্রিকতার ঘটেছিল সমন্বয়। আর তাই এখানে যৌবশোণিতের আনুকূল্যে কবি-মানসের প্রথা ও স্বভাবকে অস্বীকার করার পাশাপাশি প্রেমজ হৃদয়াবেগের সঙ্গে জীবনঘনিষ্ঠ রোম্যান্টিক চারিত্র লক্ষ না করে পারি না। ‘অগ্নি-বীণা দ্বিতীয় খণ্ড নাম দিয়ে তাতে যে সব কবিতা ও গান দেবো বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেই সব কবিতা ও গান দিয়ে এই বিষের বাঁশী প্রকাশ করলাম’- বিষের বাঁশী গ্রন্থের ‘কৈফিয়ত’ শিরোনামের ভূমিকাতে কবির এই স্বীকারোক্তি। ফলে ধরে নেয়া যায় যে, অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কবির ভাব ও ভাবনা, গঠন ও সৌকর্য পরিকল্পনায় যে পরিণতি এসেছে, এই কাব্যগ্রন্থে তার প্রভাব পড়েছে অনিবার্যভাবে। এ গ্রন্থেও কবি মানবতার জয়গান গেয়েছেন সব জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে। মানব-মুক্তি ও দেশ-মুক্তির লক্ষে কবির ঘোষণা এখানে আরও উচ্চকিত, আরও শাণিত। ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ কবিতায় তাঁর উচ্চার :
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া!’
অথবা ‘চরকার গান’ কবিতায়-
‘হিন্দু-মুসলিম দুই দোসর
তাদের মিলন-সূত্র ডোর-রে
রচলি চক্রে তোর
তুই ঘোর্ ঘোর্ ঘোর্।
আবার তোর মহিমায় বুঝল দুভাই মধুর কেমন মায়ের ক্রোড়।’
মানব-ঐক্য ও মানব-মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এ কাব্যে কবি দেশ-মুক্তির ডাক দিয়েছেন আন্তরিকভাবে। ‘শিকল পরার গান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।’
কিংবা ‘যুগান্তরের গান’ কবিতায়-
‘মোরা ভাই বাউল চারণ
মানি না শাসন বারণ
জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।’
এসব মানবতাবাদী, প্রতিবাদী আর সংগ্রামী কবিতার পাশাপাশি এ কাব্যগ্রন্থেও কবি অগ্নি-বীণার ‘গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি’র মতো রোম্যান্টিকতায় বিভোর। কবির কল্পনা তাই এখানে যথেষ্ট প্রাণবন্ত:
‘পাগলিনী মুঠি মুঠি ছুঁড়ে মারে রাঙা পদ-ধূলি
হানে গায়ে ঝর্ণা-কুলকুচ।’
[ঝড় : পশ্চিম তরঙ্গ]
শুধু তাই নয়, প্রতিবাদ আর বিদ্রোহে লৌহ-বেড়ি খুলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কবি অপরিচিত চপলার কঙ্কন-বন্ধনে আবদ্ধও হন:
‘কোন্ চপলার কেশ-জাল
কখন জড়াতে ছিল গতিমত্ত আমার চরণে
লৌহ-বেড়ী যত যায় খুলে, তত বাঁধা পড়ি কার কঙ্কন-বন্ধনে।’
[মুক্ত-পিঞ্জর]
নজরুল অতিসংবেদী এক কবিপ্রাণ। হয়তো এর আবেগের কারণেই সমকালের প্রভাব তাঁর ওপর স্পষ্ট- কোনো সুনির্দিষ্ট মতবাদে দীক্ষিত না হয়েও তাই তিনি প্রতিবাদী, সংগ্রামী। তাঁর এই প্রতিবাদী ও সংগ্রামী-চেতনার সঙ্গে প্রেমিকসত্তার সম্মিলনের ফলে এক তুঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে;- এটাই হলো কবির রোম্যান্টিক মনোভাব। সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে কবি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘মানবতা’র জয়গান গেয়েছেন:
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’
[কাণ্ডারী হুঁশিয়ার]
অথবা ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় যখন তিনি বলেন যে, হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো উপাসনার বস্তু নেই- তখন জাত-ধর্মের সব বাধা-ব্যবধান ছিন্ন হয়ে মানুষের মহামিলন রচিত হয়। এই মহামিলনের সঙ্গেই কিন্তু কবির গগন-বিদারী নিনাদ ধ্বনিত হয় যে, বিপ্লব, স্বাধীনতা, স্বরাজ ক্ষুধাতুর শিশুর অন্নের চেয়ে দামি নয় [দ্রষ্টব্য : আমার কৈফিয়ত]। ‘নারী’, ‘কুলি-মজুর’, ‘বারাঙ্গনা’ ইত্যাদি কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে নজরুলের প্রতিবাদ-দীপ্ত কণ্ঠস্বর, মানুষের প্রতি ভালোবাসা- যাকে রোম্যান্টিকতার পূর্বোল্লিখিত লক্ষণগুলোর একটি বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই প্রতিবাদ, সংগ্রামের ভেতরেও কিন্তু আর একটি সত্তা সদা জাগরুক কবি-হৃদয়ে; তারই বহিঃপ্রকাশ এভাবে:
‘ব্যথা-বারিধির
কূলে বসে কাঁদ’ মৌনা কন্যা ধরণীর
একাকিনী! যেন কোন্ পত্র-ভুলে-আসা
ভিন্-গা’র ভীরু মেয়ে!’
[মা (বিরজাসুন্দরী দেবী)-র শ্রীচরণারবিন্দে]
অথবা
‘অতন্দ্র নয়নে তব লেগেছিল চুম
ঝর ঝর কামিনীর এল চোখে ঘুম।’
[গোকূল নাগ]
কবি যখন রচনা করেন এই সব পঙ্ক্তি তখন রোম্যান্টিক কবি-চরিত্র্যে সংযোজিত হয় নতুন মাত্রা।
ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাই ‘তলোয়ার’ হাতে শক্তি সঞ্চয়ের প্রেরণা-দীপ্ত, আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার আহ্বান এবং ‘মুক্ত-স্বাধীন’ ও ‘সত্য-স্বাধীন’ চেতনা-সংরাগী। আর এরকম আকাঙ্ক্ষাই নজরুলের মুক্তি সাধনার গান:
‘গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দ্যায় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্য কে রে?’
[ভাঙার গান]
এরপর একই কবিতায় তিনি আহ্বান জানিয়েছেন বন্দিশালা লাথি মেরে ভেঙে চুরমার করে দেয়ার জন্যে। ‘দুঃশাসনের রক্ত চাই’ কবিতায় শাসক শ্রেণিকে পৌরাণিক-পাপী দুঃশাসনের সঙ্গে তুলনা করেছেন কবি। এই দুঃশাসনের রুধির গ্রহণের জন্যে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন পুরুষ-সিংহকে:
‘পুরুষ সিংহ জাগো রে
সত্যমানব জাগো রে
বাধা-বন্ধন-ভয়-হারা হও
সত্য-মুক্তি-মন্দ্র গাও।’
[জাগরণী]
কবির এই সত্যানুসন্ধানই তাঁর পরম সুন্দরের আকাঙ্ক্ষা- এ যেন ‘Beauty is truth, truth beanty’. আর এই সত্যের অন্বেষাতেই ভাঙার গান সুন্দরের অভীপ্সায় জাগ্রত। এ ছাড়াও ফণি মনসা, জিঞ্জির, চিত্তনামা, চন্দ্রবিন্দু এ-সব কাব্যগ্রন্থে কবির স্পর্ধিত প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে নানা অনুষঙ্গে। শুধু স্পর্ধিত প্রতিবাদই নয়, দেখা যায়, এই প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গে একই কাব্যগ্রন্থে তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে একই কবিতায় কবির প্রেমচৈতন্যের বহিঃপ্রকাশ। কবির প্রেম-প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলোতেও কিন্তু এর ব্যত্যয় নেই। নজরুলের প্রেম তাই ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’-এর মতো আত্মসমর্পণের প্রেম নয়; নজরুলের প্রেমেও ঝঙ্কৃত হয়েছে দ্রোহের অগ্নিবীণা। কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ দোলন-চাপা তাঁর প্রেম-প্রধান কবিতার সংকলন। এ কাব্যেও কবি ‘সৃষ্টি-সুখের-উল্লাসে’ উল্লসিত : ‘মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে’। নতুনের জন্য সৃজন-বেদন, যাকে কবি বলছেন ‘সৃষ্টি-সুখ’, যার জন্য তাঁর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমন কি রক্ত পর্যন্ত নেচে ওঠে- তা এক ধরনের রোম্যান্টিকতা বৈ-কি? এ ছাড়াও দোলন-চাঁপাতে রয়েছে নিটোল প্রেমের কবিতা, যেখানে প্রকাশিত হয়েছে প্রিয়ার সান্নিধ্য কামনা, তার সঙ্গে অনুরাগ, অভিমান। পৌরাণিক দুঃশাসনকে তিনি শোষকের তুলনায় উপস্থাপন করেছিলেন, এখানে শকুন্তলাকে সংস্থাপন করেছেন প্রেমজ আবহে:
‘কান্তে পড়ে মনে
বন-লতা সনে
বিষাদিনী শকুন্তলা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে।’
[পূজারিণী]
কবি যখন তাঁর হৃদয়ের-হৃদি-সরসিজ প্রিয়তমাকে উৎসর্গ করেন সব কিছু, তখন তিনি বড় সরাসরি কথা প্রকাশে:
‘আমার বাণী জয়মাল্য, রাণী! তোমার সবি।
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।’
[কবি রাণী]
আবার যখন অভিমানী, তখনও কিন্তু এই সরাসরি অভিব্যক্তি প্রকাশে তিনি কুণ্ঠিত নন:
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।’
[অভিশাপ]
The Canonization কবিতায় John Donne-এর প্রেমের সঙ্গে Passege to India-র হুইটম্যানের প্রেমের পার্থক্য কিন্তু হুইটম্যানের সংকল্পবদ্ধতা আর দৃঢ়তায়। Donne যেখানে প্রেমে নিমজ্জমান অনেকটা সমর্পিত হয়ে, হুইটম্যান সেখানে And we will risk the ship / Ourselves and all বলে প্রতিকূলতা অতিক্রমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নজরুল ইসলামের প্রেম ঠিক এরকম। তাঁর নারীপ্রেমে স্ফটিক স্বচ্ছতার পাশাপাশি হুইটম্যানের মতো সংকল্পবদ্ধতা ও দৃঢ়তার প্রজ্বলন লক্ষ করি, যা আত্মনিবেদনে নতশির নয়:
‘নাইবা পেলাম কণ্ঠে আমার তোমার কণ্ঠহার
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংকর!’
[এ মোর অহঙ্কার]
চক্রবাক কাব্যগ্রন্থে এরকম অনেক কবিতা আছে যেখানে নজরুলের প্রেমিক-সত্তার স্ফূরণ হুইটম্যানের সমতুল্য। এ কাব্যগ্রন্থে আছে বেদনার অন্ধকারে, প্রেমের নবপ্রভাতের প্রত্যাশার ধ্যান এবং অতীতের সুখদ স্মৃতিচারণা। যদিও চক্রবাক নজরুলের প্রেমচেতনা ও প্রকৃতি-অনুধ্যানের শিল্পিত উপস্থাপনা, তবুও একথা বলতে হয় যে, ‘নজরুলের কাব্য প্রেরণার উৎস প্রকৃতি প্রধানত নয়, বরং তাঁর রহস্যপূর্ণ আত্মপ্রত্যয়।’ আর এর মধ্য দিয়েই কবির প্রেম-সংক্রান্ত একটি দর্শনকে উপলব্ধি করা যায়। নজরুলের রোম্যান্টিক মানসজাত রহস্যবোধ ও বেদনার গৌরব নিহিত এখানেই।
চক্রবাক কাব্যগ্রন্থে যেমন, তেমনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে নজরুলের রোম্যান্টিক কবি-সত্তা প্রকাশের চমৎকারিত্ব লক্ষ করা যায় সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থেও। অবশ্য পূর্বেই বলা হয়েছে যে, নজরুলের কাব্য-প্রেরণার উৎস তাঁর রহস্যপূর্ণ আত্মপ্রত্যয়েই অনুসন্ধানযোগ্য, প্রকৃতিতে নয়। তাঁর হৃদয়জাত অনুভূতি প্রকৃতির আশ্রয়ে রূপময়, বাঙ্ময় হয়েছে- শুধু একথাই বলা যায়। সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থের ‘সিন্ধু’ কবিতাতে একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে কবির সংগ্রামচৈতন্য এবং প্রেমচেতনা। কবিতাটির তিনটি তরঙ্গে সমুদ্রের বিরহী, বিদ্রোহী ও ক্ষুধাতুর রূপ বর্ণনার মাধ্যমে কবির আন্তঃমনের ঐ ত্রিধারার যৌথ সম্মিলনই যেন প্রকাশমান। অবশ্য তিনটি তরঙ্গের ঐক্যবদ্ধতার মধ্যে সমুদ্রের বিরহী ও বেদনার্ত রূপটিই যেন স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। আসলে নজরুল ইসলাম এখানে নিজেই যেন বড় বেশি বেদনার্ত-বিরহী। কবি যখন প্রিয়ার ব্যথায় কাতর, তখন পৃথিবী তাঁর দুঃখময়:
‘কাঁদে গ্রীষ্ম, কাঁদে বর্ষা বসন্ত এ শীত
নিশিদিন শুনি বন্ধু, ঐ এক ক্রন্দনের গীত!
নিখিল বিরহী কাঁদে সিন্ধু তব সাথে,
তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে!’
[প্রথম তরঙ্গ : সিন্ধু]
অবশ্য মাঝে তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন, প্লাবনের বিষাণ বাজিয়ে জেগে উঠতে চেয়েছেন, কিন্তু তা-ও প্রেমকে অবলম্বন করেই- প্রেমের শক্তি নিয়েই। আসলে কাজী নজরুল ইসলামের দ্রোহ যতো ব্যাপকই হোক না কেন, তা কোনোভাবেই প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে নয়। আর তাই ‘সিন্ধু’ কবিতায়ও তিনি বলেন:
‘বোকা নিজ ভুল
জোয়ারে উচ্ছ্বসি’ ওঠো, ভেঙ্গে চলো কূল
দিকে দিকে প্লাবনের বাজায়ে বিষাণ,
বল, ‘প্রেম করে না দুর্বল ওরে করে মহীয়ান’।
[দ্বিতীয় তরঙ্গ : সিন্ধু]
এরপরও শেষ অবধি কিন্তু তিনি বড়ই বিরহী, রিক্ত। চারিদিকে তাঁর শূন্যতা- শূন্যতা নিজের মধ্যে, শূন্যতা প্রার্থিতজনে। আর এই হাহাকার ধ্বনি করেই তিন তরঙ্গের ‘সিন্ধু’ কবিতার সমাপ্তি। সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থে কবির বেশ কিছু নিটোল প্রেমের কবিতা স্থান পেয়েছে; যেমন: ‘চাঁদনী রাতে’, ‘বধূ-বরণ’, ‘ফাল্গুনী’, ‘বিদায়-স্মরণে’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘অ-নামিকা’ ইত্যাদি। এসব কবিতায় নজরুলের রোম্যান্টিক কবি-প্রাণ বিচিত্র ধারায় প্রকাশিত। ব্যক্তিপ্রেমকে সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ করে প্রায়শই তিনি উদ্বেলিত। তাঁর এই কথন তাই অনিন্দ্যসুন্দর বাণীরূপ লাভ করে:
‘যা-কিছু সুন্দর হেরি’ করেছি চুম্বন
যা-কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর-
সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ
অনুভব করিয়াছি!- ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে তিলে!’
[অ-নামিকা]
এরকম নির্ভেজাল প্রেমের কবিতা তাঁর দোলন চাঁপা, ছায়ানট, পূবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থে আছে। খোঁপায় চাঁপা গুঁজে প্রিয়ার ঠোঁঠে মউ ঢেলে দেবার (চৈতী হাওয়া) ব্যাগ্রতা যে কবিকে অহর্নিশ তাড়া করে, তিনি কতটা রোম্যান্টিক মন লালন করেন-তা সহজেই বোঝা যায়।
প্রকৃতপক্ষে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই রয়েছে সংগ্রাম-চৈতন্যমূলক কবিতার পাশাপাশি প্রেম-ভাবনা-সঞ্চারী কবিতার সুসমন্বিত বিন্যাস। আবার তাঁর বহু কবিতার কাব্য-শরীর নির্মিত বিদ্রোহ আর প্রণয়চেতনার যৌথ সম্মিলনে। এরপরও নজরুলের কাব্যভাবনায় শ্যামা সঙ্গীত ও ইসলামি গান, হিন্দু তান্ত্রিক সাধনা ও সুফিবাদ ইত্যাদির সমন্বয় যেমন আছে, তেমনি ধর্মান্ধতা ও ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধিতাও আছে ব্যাপক মাত্রায়। এসবই কিন্তু নজরুল ইসলামের সংগ্রামচৈতন্য ও প্রেমাবেগ এই দুই পরম বিক্রমশালী অনুভব ও বোধের সংশ্লেষ। আগেই বলা হয়েছে, কবির মনন, চিন্তন ও বোধনে সতত জাগরূক দ্রোহ আর প্রেমের অবারিত ফল্গুধারা। আর তাই তাঁর সমগ্র কাব্যশরীরের একচ্ছত্র অধিপতি কবির সংগ্রামচৈতন্য ও প্রেমিকমানস। নজরুলের মানববীক্ষা ও মনুষ্যত্ববোধের মূলসূত্রও কিন্তু তাঁর এই দ্বৈত মানসিকতার সম্মিলনে নিহিত। এ কারণেই বলা চলে যে, সংগ্রাম ও প্রেম- সমুদয় নজরুল-কাব্যসৃষ্টি-সম্ভার এই দুই ধারায় বাহ্যত বিভক্ত হলেও, আন্তরপ্রেক্ষণ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যায়, এই উভয় ধারার গোপন সম্মিলন আছে নজরুলচেতনায়, যার প্রতিফলন পড়েছে নজরুলরচনায়।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়