মোঃ খোরশেদ আলম:
একটা সড়ক দুর্ঘটনা একটা পরিবারের স্বপ্নগুলোকে নিভিয়ে দেয়। একজনের প্রস্থানে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে তার আপন জন, পরিবার পরিজনদের জীবনে। গতরাত আনুমানিক ৩টার দিকে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলার কনস্টেবল আব্দুল হান্নান মারা যান ।
আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় দেশের অন্যতম বড় দুটি হাইওয়ে। আপনারা টিভি, সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনে থাকবেন, দেখেছেন হাইওয়ে কি পরিমাণ ডাকাতি হতো। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, আপনাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে, আপনাদের নির্বিঘ্ন পথচলা অক্ষুণ্ণ রাখতে হাইওয়েতে নিয়মিত ডিউটি করার কারনে হাইওয়েতে ডাকাতি বন্ধ হয়। আমি নিয়মিত পুলিশ ফোর্স দিয়ে রুটিন চেক অনুযায়ী হাইওয়ে কন্ট্রোল করিয়ে আসছি।
আমরা উন্নয়নশীল দেশ। এক সময় আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব। উন্নত দেশের পুলিশদের মত শক্তিশালী, আধুনিক গাড়ি দিয়ে হাইওয়ের ডিউটি করাতে পারবো তখন। তবে কোনদিনও আমরা ফিরে পাবো না কনস্টেবল আব্দুল হান্নানকে। তার সন্তানরা কোনদিন ফিরে পাবেনা তাদের বাবাকে ।
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ থানার তালতলা তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন সাহসী এই নিবেদিতপ্রাণ পুলিশ সদস্য। করোনা ভাইরাসের মহামারীতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হাইওয়ের উদ্দেশ্য বের হয় সিএনজি নিয়ে! আমাদের সাধ আছে সাধ্য নেই । উন্নত দেশে পুলিশ যেসব আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ডিউটি গাড়ি নিয়ে টহল দেয় এইরকম কোন গাড়ি যদি সাইরেন বাজিয়ে, লাইট জ্বালিয়ে বের হত তাহলে হয়তো গতকাল মধ্যরাতে আমি এমন একটা দুর্ঘটনার সংবাদ পেতাম না! এশিয়ান হাইওয়ের শিংলাবো চৌরাস্তা এলাকায় সিএনজি যোগে টহল ডিউটিরত থাকাকালীন সময়ে চলন্ত অবস্থায় পিছন থেকে একটি দ্রুতগামী গাড়ি তাদের ধাক্কা দেয় আর স্পট ডেড হান্নান। অন্য ২ জন গুরুতর আহত। উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে আর ফেরানো সম্ভব হয় নাই। সে কোন দিন ডিউটি করতে বের হবেনা।
ঘটনা শোনা মাত্রই আমি উপস্থিত হই। আমি তার নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আর কোন কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না!
কনস্টেবল হান্নান বাড়ি যাবে বহুদিন পর। ঈদেও ছুটিতে যায়নি সে। একটু ভিন্নভাবে আজ সে গিয়েছে৷ এই যে তার শেষ বাড়ি যাওয়া। সবকিছু মিলিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে যাই। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তার মধ্যে সারারাত আমি নির্ঘুম। তারপর ও তার জানাযায় উপস্থিত না হতে পারলে নিজেকে অপরাধী লাগতো৷ হান্নানের ডেডবডি নিয়ে তার বাড়িতে গেলাম, তাঁকে চিরদিনের জন্য রেখে আসলাম মাটির ঘরে!
হান্নানের সন্তানদের চেহারার দিকে তাকিয়ে ওদের কষ্টটা অনুভব করা গেলেও, মর্মস্পর্শী হলেও ওদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতি কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব না।
বাংলাদেশ পুলিশের জীবন্ত কিংবদন্তী, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, জনাব হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) মহোদয় এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার সুযোগ্য পুলিশ সুপার জনাব মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম (বার) মহোদয়ের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। স্যারদের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্মানজনকভাবে কনস্টেবল হান্নানকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছে।
ঢাকা রেঞ্জের আমাদের অভিভাবক, ডিআইজি মহোদয় ও নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মহোদয় সার্বক্ষণিক খোঁজ নিয়েছেন৷ অসহায় এই পরিবারের পাশে আছেন। হান্নানের শিক্ষিত সন্তানদের কর্মসংস্থনের ব্যবস্থা করে তাদের ভালো রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
সোনারগাঁ থানার অফিসার ইনচার্জ জনাব মোঃ মনিরুজ্জামান ও তালতলা তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক জনাব মোঃ আহসান উল্লাহ কে ধন্যবাদ। কনস্টেবল হান্নানের ডেডবডি নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া, দাফনকাজ সম্পাদনে পাশে ছিলেন ।
একদিন আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো। আমাদের বহরে অত্যাধুনিক টহল গাড়ি যোগ হবে৷ হাইওয়েতে তখন আর এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হবেনা। আপনারা হয়ত ভুলে যাবেন কনস্টেবল হান্নানকে! বাংলাদেশ পুলিশ কোন দিন ভুলবেনা৷ হান্নানের মত এমন অসংখ্য পুলিশ সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের সেবায় নিয়োজিত।
সবাই দোয়া করবেন ।
লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
নারায়নগঞ্জ ‘খ’ সার্কেল।