নাসরিন পারভেজ:
(১)
একদল উদ্যমি, তারুণ্য ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর সাহসী যুবক দেশের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিতে, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে ইন্ডিয়া সীমান্তের (নোয়াখালী, ছোত্তাখোলা বর্ডার) কাছাকাছি পৌছালো। হঠাৎ প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু করে পাকসেনারা। দিশেহারা হয়ে ছোটাছোটি শুরু করে যুবকেরা। আপন দুই ভাই ছিটকে পড়ে রেললাইনের দুইপাশে আলাদা হয়ে যায়। ধানখেতে লুকিয়ে তারা এ যাত্রায় বেঁচে যায়। জীবন বাচাতে একদিন একরাত অভুক্ত পার হয় এই ধানখেতে। দুই ভাই কেঁদে সারা, বড় ভাই ভেবেছিলো ছোট মারা গেছে, ছোট ভেবেছিল বড় ভাই মারা গেছে, আর বুঝি দেখা হলো না প্রিয় ভাইয়ের মুখ! কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আল্লাহ দুজনকেই বাচিয়ে রাখলেন দেশের দুর্দিনে দেশকে রক্ষা করার জন্য। পরদিন খুজে পেল ছোটকে। তারপর দুজন ইন্ডিয়া পৌঁছে ছোট ভাইকে স্পেশাল প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করে দেন। দুজনই সসস্ত্র যুদ্ধ করেন দেশের জন্য। এই দুই ভাইয়ের একজন হলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ (আব্বা) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কালাম (ছোট কাকা)।
(২)
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই প্রায়, মিলিটারিদের নৌকা খুব কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে। দাদা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে করনীয় নির্ধারণ করেই অবিবাহিতা সুন্দরী ছোট ফুফুকে ভর পানিতে নামিয়ে দিলেন সাঁতরে ছোট দাদাদের (জব্বার সওদাগর) বাড়ীতে গিয়ে উঠতে। একে তো সন্ধ্যে তার উপর বর্ষা। সাপখোপের ভয়ের চেয়ে হয়েনাদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করাই তখন একমাত্র লক্ষ্য ফুফু ও দাদ দাদির। নিজেদের রক্ষা করার কথা মাথায় নেই।
দাদা দাদি ঘরে ঢুকতেই মিলিটারি ও রাজাকাররা দাদার বুকে অস্ত্র তাক করলো উর্দুতে বললো তোর মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা কোথায় বল নয়তো গুলি করবো। দাদা বললেন জানিনা, বেয়নেট দিয়ে দাদাকে আঘাতের পর আঘাত। আবার জিজ্ঞেস করে চললো, দাদা আবারও বললেন তারা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পরে আর বাড়ি আসেনি। শুনেছি ইন্ডিয়াতে প্রশিক্ষণ নিতে গেছে। আল্লাহর কসম আমি জানিনা এখন তারা কোথায় আছে। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানিনা!
আলমারি ও সিন্দুকের চাবি দিতে বললো দাদা দিতে চাইছিলেন না। দাদির বুকেও বেয়নেট চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো। দাদি নরম মনের প্রচন্ড ভীতু নারী। ঘর সংসারের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। প্রচন্ড ভয় পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন চিরতরে।
দাদা দাদিকে তারা মারলেন না। কারণ তাদেরকে টোপ হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাচিয়ে রাখলো এবং প্রচুর আঘাত করে চলে গেল। দাদা ও দাদি দুজনের একসাথে হজে যাওয়ার কথা। আগের বার দাদা একা হজ করে এসেছেন। সিন্দুক খুলে হায়েনার দল টাকা,পয়সা,স্বর্ণালংকারসহ সব মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেল।। উল্লেখ্য, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আম্মা আমার তিন ভাই বোনকে নিয়ে নানাবাড়িতে থাকতেন। কারণ আমাদের বাড়ি আব্বা ও কাকার উপর রাজাকার ও পাকসেনাদের নজরদারিতে ছিলো।
এই ঘটনায় দাদি প্রচন্ড ভয় পেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো কথা বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তার ডাকা হলো, দাদির অবস্থা খারাপ হতে থাকলো। আব্বা ও কাকা খবর পেলেন। কিন্তু বাড়িতে এসে দাদিকে দেখা সম্ভব ছিল না। কারণ হায়েনার দল হন্যে হয়ে আব্বার মতো চৌকস এক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজছে মেরে ফেলার জন্য। আব্বা সব খবর জানতেন বিস্বস্ত মুক্তিযোদ্ধা গুপ্তচরদের মাধ্যমে, তাই গা ঢাকা দিয়ে দেশের জন্য লড়ছেন।
এর মধ্যে দাদি এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলেন। আব্বা খবর পেলেন, কিন্তু আসার উপায় ছিলো না। ঐতিহাসিক নবীশুর মসজিদের সামনে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হলো। আব্বা হাওরা (নানাবাড়ি) গ্রাম (তখন বাড়ি ঘর খুব কম ছিল তাই এক গ্রাম থেকে পরের গ্রামগুলো পরিস্কার দেখা যেতো) থেকে দেখলেন, কেঁদে বুক ভাসালেন গর্ভধারিনি মায়ের জন্য। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আব্বা ও কাকাকে বেধে রাখলেন যাতে জানাজায় না আসেন। কারণ জানাজায় আসলেই আব্বা ও কাকাকে মেরে ফেলতো রাজাকার ও পাকসেনারা। চিরতরে মা শায়িত হচ্ছে অথচ কাছে আাসার কোন সুযোগ ছিলো না। সেখান থেকেই পরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মিলে জানাজা ও দোয়া সম্পন্ন করে আবার রণাঙ্গনে ফিরে গেলেন।
হারিকেনের মৃদু আলোয় ইলেক্ট্রিসিটি বিহীন একটি গ্রামে জীবনের বহু সন্ধ্যা আমাদের সাতভাই বোনের কেটেছে এরকম যুদ্ধ ও বিজয়ের গল্প শুনে। এসব সাহসী ও ত্যাগি গল্প শুনে গর্বে বুক ফুলে উঠতো আর বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকার গ্রামটাও যেন আলোয় ঝলমল করে উঠতো।
সামাজিক কর্মকাণ্ড:
আমার জন্য, আমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ এনেই বসে থাকেননি জাতির এই সূর্য সন্তানেরা। এরপর লেগে গেলেন দেশ গড়ার কাজে, হুম কোন কোন সন্ধ্যায় শুনতাম মনোহরগন্জ স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প, বাশার কাকা, আলমগীর মামা সহ এলাকাবাসীর সহায়তায় নানা কাঠখড় পুড়িয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। চারজন স্বপ্নবাজ তেজি মুক্তিযোদ্ধা যুবকের স্বপ্নের ফসল এই দক্ষিণ লাকসামকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার প্রয়াস আজকের মনোহরগন্জ স্কুল এন্ড কলেজ!
ছোট্ট আরও একটা মুগ্ধতা আব্বাকে ঘিরে:
ছোট্ট একটা উদাহরণ (এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা আছে) পিতৃহীন একটি মেয়ের বিয়ে দিলেন নিজ হাতে পাশের গ্রামে। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে কন্যাদায়গ্রস্ত মা এসে প্রায়ই এসে কান্নাকাটি করতেন। এক সন্ধ্যায় একজন মায়ের যন্ত্রনার লাঘব করে মেয়েটিকে সুখের একটি সংসার উপহার দিলেন আব্বা। আহা সেই জননী দুহাত তুলে খোদার দরবারে আব্বার জন্য কতশত যে প্রার্থনা তার!
বাবা:
আব্বা ফল বেশ পছন্দ করতেন। প্রতিদিন কোন না একটি ফল খেতেন। খুব অল্প ভাত খেতেন মাংস অথবা এক পিস বড় মাছ দিয়ে। বাকি ভাতটুকু আম, কাঁঠাল অথবা তাল সাথে দুধ দিয়ে খেতেন। আমরা কোনদিন ফল কেটে খাইনি। আব্বা নিজ হাতে কেটে খাওয়াতেন, বিয়ের পর শশুর মশাই বলেছিলেন কাঁঠাল খুলে দিতে। আমি বললাম আমিতো পারিনা, সবসময় আব্বা খুলে দিতেন। তারপর থেকে এই দ্বিতীয় বাবাও আমাকে কাঁঠাল খুলে খাওয়ান। বড় মাছ এনে আম্মাকে কাটতে দিতেন না নিজ হাতে কাটতেন নিখুত সুন্দর করে অথচ। আমি নিজেই এই জীবনে মাছ কাটতে জানিনা, রান্নায়ও আব্বার জুড়ি মেলা ভার। তার যে কোন গুণ ছিলো না আমার জানা নেই।
হোস্টেল থেকে বাড়িতে আসলে জোরে একটা ঢেকুর দিলেও আব্বা কষ্ট পেতেন, বলতেন আহারে মেয়েটা হোস্টেলে থেকে ভালো করে খেতে পারেনা তাই অমন এসিডিটির সমস্যা। অনেক আফসোস করতেন, জ্বর হলে রাতে একটু উহ করলেই আব্বা পানি নিয়ে শিওরে এসে দাড়িয়ে থাকতেন। কি করে ভুলি আব্বাকে, দৈনন্দিন জীবনে সবকিছুতেই আব্বাকে খুঁজে পাই, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা পেয়েছি বোধ হয়।
ছিলেন বেশ সৌখিন একজন মানুষ, মাছ ধরার ভীষণ নেশা ছিলো ( এটা আমিও পেয়েছি)। হারুন কাকাসহ অনেক মাছ ধরেছেন, বড়শি, বোয়াল জাল দিয়ে। আব্বার কালেকশনে মাছ ধরার অনেক সুন্দর সুন্দর ও দামী অনেক উপকরণ ছিলো।
পান খেতেন বাহারি সব মসলা, জর্দা দিয়ে। আব্বার পানের টেবিলে ১২/১৪ পদের মসলা পাতি থাকতো। নিজ হাতে পান বানাতেন। কাউকে কোন কাজে অযথা ডাকাডাকি করে কষ্ট দিতেন না। আম্মা সাংসারিক যেকোন প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা বললেই সামনে হাজির করে ফেলতেন। এলাকার বিভিন্ন মানুষের সমস্যা মিটিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরতেন। দরজা খোলা থাকতো (এখন আর এটা সম্ভব হয়না চোর ডাকাতদের উপদ্রব অনেক) রাতের খাবার টেবিলে দেয়া থাকতো। নিজের মতো করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। তিন ছেলের বউ কিংবা আম্মাকেও ডেকে বিরক্ত করতেন না।
বাস্তব জীবনে চারপাশের কিছু মানুষ তাকে ভালো থাকতেই দেননি। আবার পেয়েছেন অনেক মানুষের প্রচন্ড ভালোবাসাও। দাদাকে আব্বা কাকাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড খেপিয়ে তুললো কিছু অমানুষ। ইতিহাসের বিরল ঘটনা দাদা তার এই তথা জাতির সূর্য সন্তানদের ত্যজ্য করলেন, দাদাকে বিয়ে দিয়ে সন্তানদের ত্যজ্য করে, সংসারটা ধ্বংস করে কিছু মানুষ পৈশাচিক আনন্দ পেলো। মৃত্যুকালে দাদার সব রাগ পড়ে গিয়েছিল। সব সম্পত্তি আব্বার নামে লিখে দিতে চাইছিলেন। কিন্তু আব্বা আর সম্পত্তি নেননি জেদ করে। সেসব ভাঙ্গনের রেশ আজও বিদ্যমান। সেই সংসারে আর জোড়া লাগেনি।
প্রয়োজনে সিংহের মতো গর্জন করতেন আবার প্রয়োজনে নরম কোমল হতেও সময় লাগতোনা। আব্বাকে আমি ছাড়া ঘরের সবাই প্রচন্ড ভয় পেতো। আব্বা ঘরে ঢুকলেই পিন পতন নিরবতা। একমাত্র আমার কোন জিনিস কোনওসময় কোনভাবে বাদ পড়লে আব্বার পিঠে কিল দিতে দিতে অবস্থা খারাপ করে ফেলতাম। একমাত্র আমার জন্য সাতখুন মাফ ছিলো। আব্বা বলতেন আমার ছোট মেয়ে যা খুশি করবে ওকে কেউ কিছু বলতে পারবেনা ❤।
দেখতে বেশ সুশ্রী মানুষটি সর্বাবস্থায় শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলতেন। কখনো উচ্চাকাঙ্খা ছিলো না। ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু সবসময় সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। এমনকি সব অনুষ্ঠানে তিনি লুঙ্গি পরে যেতেন। জীবনে কখনও প্যান্ট পরেননি, অনেকে লুঙ্গি পরা নিয়ে বিব্রত হতেন অথচ আমাদের ছেলেদের জাতীয় পোশাক লুঙ্গি।
জীবনের প্রথম শিক্ষক আম্মা আব্বা দুজন, শিখিয়েছেন সত্য ও সুন্দরের সাথে মাথা উচু করে বাঁচতে। আমরা সাত ভাইবোন সেই সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করেই জীবন যাপন করার চেষ্টা করেছি সবসময়।
২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর আমার অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফরম ফিল-আপের টাকা নিয়ে সকালে আমার হোস্টেলে আব্বার যাওয়ার কথা, নাহ সেই সকাল আর এলোনা জীবনে। একটি মেয়ের হোস্টেল গেটে দাঁড়ানোর অপেক্ষার অবসান বিধাতা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন! সেদিন জীবনে গায়ে সাবান না মাখা ফর্সা মানুষটা মাথায় নাকি প্রথম ও শেষবারের মতো শ্যাম্পু করে পরিচ্ছন্ন একটা গোসল দিলেন। রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে নিজ হাতে কবুতরের মাংস দিয়ে ভাত খেলেন আল্লাহর কাছে যাওয়ার জন্য। তারপরের হিসেব আমার আর মিলেনি। ৭০ বছর বয়সে হাই প্রেশার ছাড়া আর কোন অসুস্থতা ছিলোনা। বটগাছটা হঠাৎই উপড়ে পড়লো, যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল।
এই যে অজপাড়াগাঁয়ের একটি মেয়ের হারিকেনের আলোয় এইচএসসি পাশ করে, শহর থেকে মাস্টার্স শেষ করে আইসিটি টাওয়ার পর্যন্ত আসা পুরোটাই আব্বার জন্য। আব্বা ছাড়া পরিবারের কেউ চায়নি মেয়েটা এতোটা পথ আসুক। হ্যা আব্বা আপনি দেখে যেতে পারেননি সবকিছু, কিন্তু আপনার আদর্শ থেকে একবিন্দু বিচ্যুত হইনি, অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করিনা, আপনার মতোই মাথা উচু করে বাঁচতে চাই মানুষের ভালোবাসা নিয়ে, আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসি করুন।