সব প্রস্তুতি সম্পন্ন থাকার পরও সিঙ্গাপুর সরকারের গ্রিন সিগন্যাল না থাকায় প্রবাসীদের ভোটার কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রবাসীদের ভোটার করা নিয়ে সিঙ্গাপুর সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে একাধিকবার চিঠি চালাচালি হলেও এখনো অনুমতি মেলেনি। যদিও সর্বশেষ সিঙ্গাপুর সরকার ভোটার কার্যক্রমে কতজন লোক একসাথে জমায়েত হতে পারে, কিভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এবং ভোটার কাজের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নিয়েছে। যদিও ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর প্রত্যাশা করছেন দ্রুত সিঙ্গাপুর সরকারের অনুমতি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, অনুমতি পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা কার্যক্রম শুরু করব।
গত সেপ্টেম্বর মাসে সিঙ্গাপুর থেকে প্রবাসীদের ভোটার কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করেছিল কমিশন। সেই মোতাবেক সব ধরণের প্রস্তুতি রাখা হয়েছিল কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় সিঙ্গাপুর সরকারের অনুমতি। এর আগে কমিশনের একাধিক প্রতিনিধি দল সিঙ্গাপুরে গিয়ে সফলভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছে।
মো. আলমগীর বলেন, সিঙ্গাপুরে প্রবাসীদের সংখ্যা কম। কাছের দেশ। এরপর আমরা মধ্যপ্রাচের দিকে যাব। ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা সৌদি আরবে এ বিষয়ে সম্ভাবতা যাচাই করে এসেছেন। সেখানে অবস্থিত প্রবাসী, দূতাবাসের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে ব্যাপক আগ্রহের কথা জানানো হয়েছে।
ইসির এনআইডি অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) মো. আবদুল বাতেন জানিয়েছেন, প্রবাসীদের এনআইডি দেয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন নেয়া হবে। যারা অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন না, তারা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে বসানো ডেস্ক থেকে এ সংক্রান্ত সহায়তা পাবেন। ইসির প্রতিনিধি দল গিয়ে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশন সেন্টারে সংশ্লিষ্টদের ছবিসহ আইরিশ ও ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করবেন। প্রবাসীদের লেমিনেটিং নয়, অচিরেই সরাসরি স্মার্টকার্ড তুলে দেয়া হবে।
প্রবাসী অধ্যুষিত রাষ্ট্রের বাংলাদেশী দূতাবাস সমূহের রাষ্ট্রদূত ও হাই-কমিশনারসহ এ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে গত বছরের ১৯ এপ্রিল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ওই সেমিনারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি এবং দশম জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি, প্রবাসে থাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নিয়ে প্রবাসীদের দ্রুত ভোটার করার সুপারিশ করেন। এরপর চলতি বছরের ৩-৯ মার্চ নির্বাচন কমিশন সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দলটি সিঙ্গাপুর যান। সিঙ্গাপুরে ভোটার নিবন্ধন বিষয়ে ইসির ইন্সপেকশন টিম ফিজিবিলিটি স্টাডি করে। এছাড়াও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও সিঙ্গাপুরে যান। প্রবাসীদের ভোটার করার বিষয়ে ইতিবাচক সুপারিশ উপস্থাপন করেন সবাই।
সিঙ্গাপুরের পর যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার করে নিয়ে সে দেশেই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সরবরাহ করতে উচ্চপর্যায়ের টিম সম্ভাবতা যাচাইয়ে পাঠানো হয়। তার আগে মালদ্বীপেও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। দুবাইও সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০টি দেশে প্রবাসীদের ভোটার করা হবে। পর্যায়ক্রমে বাকীসব দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ভোটার তালিকার আওতায় আনা হবে। প্রতিটি দেশে তিনমাসব্যাপী ইসির বিশেষজ্ঞ টীম গিয়ে ভোটার নিবন্ধন করবেন।
যেভাবে ভোটার হবেন প্রবাসীরা: প্রবাসীদের ভোটার করার আগে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে। পাশাপাশি অনলাইনে ভোটার হওয়ার ফরম ছাড়া হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই ফরম পূরণ করবেন ভোটারযোগ্যরা। অনলাইনের ফরমগুলো দেশের বিভিন্ন উপজেলা অফিসের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হবে। অনলাইনে পূরণকৃত ফরমের তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট প্রবাসীদের ছবি, আইরিশ ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নিবেন ইসির ৫ সদস্যর একটি টীম। যারা অনলাইনে ফরম পূরণ করতে ব্যর্থ হবেন, তাদেরকে তাৎক্ষণিক ভোটার করার জন্য ফরম দেয়া হবে। ওই ফরমগুলো ইসির নির্ধারিত বিশেষজ্ঞ টীমের সদস্যরা প্রবাসীদের সব ডকুমেন্টস দেশে সংশ্লিষ্ট (স্থায়ী ঠিকানায়) উপজেলা নির্বাচন অফিসে অনলাইনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবেন। প্রবাসীদের জন্য যে ভোটার ফরম তৈরি করা হয়েছে তাতে তিনটি ঠিকানা লেখার অপশন রাখা হয়েছে। ফরমে থাকবে দেশের স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা এবং যে দেশে ভোটার হবেন, সেই দেশে অবস্থানের ঠিকানা।
বাংলাদেশের মতো কয়েকটি নিবন্ধন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে নিবন্ধন কেন্দ্রে গিয়ে বায়োমেট্রিক দিয়ে আসতে পারবেন প্রবাসীরা। এরপর নির্বাচন কমিশন প্রবাসীদের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করবে। এনআইডিগুলো ছাপিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে পাঠানো হবে। ওই দূতাবাস থেকে প্রবাসীরা তাদের স্মার্ট এনআইডি সংগ্রহ করতে পারবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে দেশের উচ্চ আদালত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার সংবিধান স্বীকৃত বলে ঘোষণা দেন। দীর্ঘ ২০ বছরেও সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বিশ্বের ১৫৭টি দেশে কোটির উপরে প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। এর আগে ১/১১ ড. শামসুল হুদা কমিশনের দুজন কমিশনার এ বিয়য়ে অভিজ্ঞতা নিতে যুক্তরাজ্য সফর করেছিলেন। এর পেছনে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের ভোটার করা সম্ভব হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে ভোটার তালিকা আইন সংশোধন করে, যার লক্ষ্য ছিল বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটার তালিকায় এনে তাদের ভোট দেয়ার পথ তৈরি করা। বর্তমান কমিশনের এই উদ্যোগে তাদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের অবসান হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা।
উল্লেখ্য, ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে ১০ কোটি নাগরিক ভোটার তালিকাভুক্ত। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ১ কোটির মত।