আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বেইজিং: চীনের অসাধারণ উত্থান বিংশ শতাব্দীর এক চমৎকার কাহিনী। দেশটিতে কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের ৭০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে প্রস্তুতির প্রাক্কালে কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের মধ্যে কে আসলে জয়ী হল সেই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
তিয়ানজিন শহরে ঝাউ জিংজিয়া নামে এক ব্যক্তির সামনে বসে এই অনুসন্ধানই করেছেন সাংবাদিক জন সাডওয়ার্থ। খবর বিবিসি বাংলার
ঝাউ জিংজিয়া কাগজ কেটে কেটে আধুনিক চীনের জনক মাও সেতুং-এর ছবি চিত্রিত করছিলেন।
এই অবসরপ্রাপ্ত তেল ইঞ্জিনিয়ার, পরবর্তীতে নিজের মধ্যে ব্লেড দিয়ে নকশা কাটার দক্ষতা আবিস্কার করেন।
তার সময় এখন কাটে প্রাচীন কাগজ কাটা পদ্ধতির মাধ্যমে চীনের কমিউনিস্ট ইতিহাসের বিভিন্ন গৌরবের ঘটনা এবং নেতাদের ছবি ফুটিয়ে তুলে।
তিনি বলেন, আমার আর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন-এর সমান বয়স। আমার মাতৃভূমি, দেশের জনগণ আর আমার দলের প্রতি রয়েছে এক গভীর অনুরাগ রয়েছে।
১৯৪৯ সালের পহেলা অক্টোবর, যে দিনটিতে মাও সেতুং চীনের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তার কিছুদিন আগে জন্ম তার।
চীনের দারিদ্র, সংগ্রাম আর নাটকীয় সমৃদ্ধির ইতিহাসের অংশীদার হয়ে আছেন ঝাউ।
এখন, তাঁর পরিমিত অথচ আরামদায়ক এই অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর শিল্প তাঁকে মানব ইতিহাসের অন্যতম গোলমেলে সময়টিকে অনুধাবন করতে সহায়তা করছে।
মাও কি একজন দানব ছিলেন না? এই প্রশ্নই করা হয়েছিল তাকে, তার কোটি কোটি দেশবাসীর মৃত্যুর দায় কি তার নয়?
জবাবে তিনি বলেন, আমি এর মধ্য দিয়েই বেঁচে ছিলাম। আমি বলতে পারি যে হ্যাঁ, চেয়ারম্যান মাও কিছু ভুল হয়তো করেছেন কিন্তু সেটি তিনি একা করেন নি।
তাঁকে আমি হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাদের দেশকে মুক্ত করেছেন। সাধারণ কোন মানুষ এমনটি করতে পারে না।
মঙ্গলবার চীন পুরো বিশ্বের কাছে তার এই গৌরবকে উপস্থাপন করবে।
কমিউনিস্ট পার্টির শাসনকে একটি শুদ্ধ রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে উদযাপন করতে দেশটি সর্বকালের অন্যতম বৃহৎ সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছে।
দিনটিতে বেইজিং কাঁপবে হাজারো ট্যাঙ্ক, মিসাইল লঞ্চার এবং ১৫ হাজার সশস্ত্র সৈন্যের পদযাত্রায়।
জাতীয় শক্তি আর সম্পদের এই প্রদর্শনী তিয়ানমেন স্কয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ করবেন বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
উন্নতির এক অসম্পূর্ণ আখ্যান
ঝাওয়ের কাগজ-কাটা প্রতিকৃতির মতো, আমরা চীনের আধুনিক ইতিহাসের সময়কার ক্ষতগুলোয় আলাদাভাবে মনোনিবেশ করতে চাইছি না।
শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী হয়েছিল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এবং চীনের রূপান্তর ছিল আসলেই চমকপ্রদ।
১৯৪৯ সালের পহেলা অক্টোবর, চেয়ারম্যান মাও, তিয়ানমেন স্কয়ারে দাঁড়িয়ে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত, আধা সামন্তবাদী রাষ্ট্রকে একটি নতুন যুগে নিয়ে যাবার ঘোষণা দেন।
সে সময় সামরিক কুচকাওয়াজে যুক্ত হতে পেরেছিল মাত্র ১৭টি বিমান।
বিপরীতে এই সপ্তাহের প্যারেডে থাকছে দূরপাল্লার আন্তঃমহাদেশীয় পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র, সুপারসনিক স্পাই ড্রোন- বলা যায় এগুলো উদীয়মান, শক্তিশালী ৪০ কোটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিজয়ের চিহ্ন।
এটি একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের বিবরণ- যদিও বেশিরভাগ অংশেই এটি সত্য- তবে অসম্পূর্ণ।
চীনে বাইরে থেকে নতুন যারা আসেন, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, হাইটেক মেগাসিটিগুলির চাকচিক্যময় মহাসড়ক আর হাইস্পিড রেল নেটওয়ার্ক দেখে মুগ্ধ হয়ে যান।
দেশটির বাসিন্দাদের মধ্যেই রয়েছে একটি বিশাল ভোক্তা গোষ্ঠী যারা নিজেদের স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং স্বাধীনভাবে ডিজাইনার পণ্য কেনাকাটা করছে, বাইরে খাওয়া দাওয়া করছে, বিচরণ করছে ইন্টারনেটে।
চীন সম্পর্কে যারা নেতিবাচক সংবাদ দেখেছিল, এরপর দেশে ফিরে তখন তাদের প্রশ্ন জাগে কিভাবে দেশটি এত খারাপ হতে পারে?
উত্তরটি আসলে নির্ভর করে যে আপনি কে, সেটার ওপর।
এসব নগরের বাসিন্দা- যারা এতো সব সম্পদ সুযোগ, আর প্রাচুর্যের সুবিধা নিচ্ছে- তারা সত্যিই কৃতজ্ঞ এবং অনুগত।
বিদেশি মিডিয়াতে প্রায়শই যে অভিযোগ ওঠে যে স্থিতিশীলতা আর উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিনিময়ে চীনের মানুষ রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সেন্সরশিপকে অনেকেই মেনে নেন ।
তাদের জন্য প্যারেডটিকে জাতীয় সাফল্যের প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কিন্তু আধুনিক চীন গড়ে ওঠা গভীরের ক্ষত আরও বিস্তৃত।
হত্যা, বন্দী ও প্রান্তিকদের কথা
মাও-এর কৃষি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনায় যেসব লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয় চীনের পাঠ্যপুস্তকে তার বিবরণ নেই ।
তার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে এক দশক ধরে সহিংসতা আর নিপীড়নের উন্মত্ততায় লক্ষাধিক মানুষের যে মৃত্যু হয়- নেই তাদের কথাও।
মাও সেতুং এর মৃত্যুর পরেও, এক সন্তান নীতি প্রায় ৪০ বছর ধরে জনসংখ্যায় এক বিপর্যয় নিয়ে আসে।
বর্তমানের দুই সন্তান নীতির মাধ্যমেও,এই দলটি একজন সাধারণ মানুষের তার পছন্দমতো সন্তান নিতে চাইবার অধিকারকে লঙ্ঘন করছে।
একদলীয় শাসনে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্তদের সংখ্যার তালিকা তাই কেবল দীর্ঘই হবে।
রয়েছে ধর্মীয় দমন, স্থানীয় সরকারের ভূমি দখল ও দুর্নীতির চিত্র।
দেশটির শিল্প সাফল্যের যারা মেরুদণ্ড- সেই লক্ষ লক্ষ অভিবাসীরা বহুদিন বঞ্চিত ছিল নাগরিক সুবিধা থেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং-এর প্রায় দেড় মিলিয়ন মুসলিম- ইউঘুর, কাজাখ এবং অন্যান্যদের ভিন্ন বিশ্বাস ও জাতিসত্তার জন্যে বন্দীশিবিরে রাখা হয়েছে।
চীন জোর দিয়ে দাবি করছে যে তারা বৃত্তিমূলক বিদ্যালয়, যা অভ্যন্তরিণ সন্ত্রাসবাদ রোধে নতুন পথের খুলে দিচ্ছে।
মৃত, কারাগারে বন্দী ও প্রান্তিক মানুষের গল্প, সাফল্যের কাহিনীর তুলনায় অনেক বেশিই গোপন থাকে।
তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গেলে, চীনের সাম্প্রতিক ইতিহাসের বড় অংশজুড়ে সেন্সরশিপ রয়েছে সেটা কেবল স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির বিনিময়ে পাওয়া নয়।
এটি এমন একটি বিষয় যা তাদের নীরব কষ্টকে আরও কঠিন করে তোলে।
তবে বিদেশী সাংবাদিকদের কাজ, চেষ্টা করে যাওয়া।
মিথ্যা, নকল এবং মহিমান্বিত
কিন্তু সেন্সরশিপ হয়তো মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে পারে, তবে তাদের চিন্তাকে আটকাতে পারে না।
বেইজিং-এর সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক গুও ইউহুয়া সেইসব অল্প সংখ্যক বিদ্বানদের অন্যতম, যিনি দেশটির বিগত সাত দশককে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহের মাধ্যমে।
তার বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তিনি কার সাথে যোগাযোগ রাখেন সেসব নজরদারিতে রয়েছে এবং তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিয়মিতই বন্ধ করে দেয়া হয়।
বেশ কয়েকটি প্রজন্ম ধরে মানুষ এমন এক ইতিহাস জেনেছে যা কিনা মিথ্যা, নকল, মহিমান্বিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে হোয়াইট ওয়াশ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন যে, কুচকাওয়াজের আগে বিদেশী গণমাধ্যমের সাথে কথা না বলার ব্যাপারে তাকে সতর্ক করা হয়েছে।
দেশটির ইতিহাস পুনঃঅধ্যয়ন করার ব্যাপারে জোড় দেন তিনি। শুধুমাত্র এর মাধ্যমে ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বিশ্বাস করেন যে একটি কুচকাওয়াজ কমিউনিস্ট পার্টিকে গল্পের প্রথমে এবং কেন্দ্রস্থলে রাখে।
তবে সেখানে একটি বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয় আর সেটা হল, মাও এর শাসনের পরই চীনের অগ্রগতি শুরু হয়েছিল।
তিনি বলেন, মানুষ একটি উন্নত, সুখী এবং সম্মানজনক জীবন পাওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে, তাই না?
যদি তাদের একটি ছোট্ট সামান্য জায়গা দেয়া হয় তবেই তারা ভাগ্য তৈরি করার চেষ্টা করবে এবং তাদের বেঁচে থাকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। এর জন্য নেতৃত্বকে দায়ী করা উচিত নয়।
আমাদের সুখ আসে কঠোর পরিশ্রম থেকে
কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলির অস্থিতিশীলতা এবং, সেন্সরযুক্ত অতীত কীভাবে বর্তমানকে প্রভাবিত করে সে বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য, কুচকাওয়াজ কেবল আমন্ত্রিত অতিথির জন্য আয়োজন করা হয়েছে।
৩০ বছর আগের গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভের রক্তাক্ত দমন হয়েছিল যে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে- সেখানেই আরও একটি বার্ষিকী পালন হতে যাচ্ছে।
যেখানে সৈন্যরা প্যারেড করবেন- যেমনটি তারা সবসময়েই করে থাকেন- সেখানেই শিক্ষার্থীদের গুলি করা হয়েছিল।
যে জনতার সম্মানে এই প্যারেডের আয়োজন করা হয়েছে চীনের সেই সাধারণ মানুষের জন্যে প্যারেডের স্থানটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় বেইজিং। তারা কেবল টিভিতে এটি দেখতে পারবেন।
তিয়ানজিনের অ্যাপার্টমেন্টে ঝাউ জিংজিয়া একটি ধারাবাহিক দৃশ্যের জটিল সব চিত্র দেখান, এক খণ্ড কাগজ কেটে সেখানে লং মার্চ চিত্রিত করেছেন তিনি।
কমিউনিস্ট পার্টির জন্য সেটা ছিল কঠোরতা ও বিপর্যয়ের সময়।
তিনি বলেন, আমাদের সুখ এখন আসে কঠোর পরিশ্রম থেকে। এটি এমন একটি মতামত যা চীন সরকারের মতের প্রতিফলন ঘটনায়। তিনি অন্তত স্বীকার করেছেন যে মাও ভুল করেছিলেন।
তিনি বলেন, চীনের ৭০ বছর পূর্তি হিসাবে এটি অসাধারণ। এটি সবাই দেখেছে যে হ্যাঁ গতকাল আমরা মহাকাশে দুটি নেভিগেশন উপগ্রহ পাঠিয়েছি সব দেশের নাগরিকরা আমাদের মতো সুবিধা ভোগ করতে পারছে।