রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগারসহ মোট ৬৮টি কারাগারে অসুস্থ বন্দিরা ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এসব কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ৩৬ হাজার ৭১৪। তবে সর্বশেষ (২৯ সেপ্টেম্বর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বন্দির সংখ্যা ৯২ হাজারেরও বেশি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এত বিপুলসংখ্যক হাজতি ও কয়েদির চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসক মাত্র নয়জন অর্থাৎ প্রতি ১০ হাজার বন্দিকে চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক মাত্র একজন।
কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বন্দিদের মধ্যে অনেকেই হৃদরোগ, কিডনি ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। অধিকাংশ কারাগারে চার-পাঁচগুণ বেশি বন্দি অবস্থান করায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। এতে বন্দিদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন কারা কর্মকর্তারা।
কারা অধিদফতরের আইজি প্রিজন (ভারপ্রাপ্ত) ওবায়দুর রহমান জানান, কারাবন্দিদের চিকিৎসাসেবার জন্য ৬৮ কারাগারের কারা হাসপাতালের জন্য মোট ১৪১টি পদ (সহকারী সার্জন ৭০, নারী সহকারী সার্জন ১২, প্যাথলজিস্ট ১২, মেডিকেল অফিসার ১১, তত্ত্বাবধায়ক হাসপাতাল ১, সিনিয়র কনসালট্যান্ট ২, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ১০, আবাসিক চিকিৎসক ৫, রেজিস্ট্রার ১, সহকারী রেজিস্ট্রার ১, রেডিওলজিস্ট ১, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ১, মেট্রন হাসপাতাল ১, মনোবিজ্ঞানী ১ ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ১২ জন) পদ সৃষ্টি করা হলেও এসব অনুমোদিত পদের বিপরীতে বর্তমানে মাত্র আটজন সহকারী সার্জন ও একজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট কর্মরত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী দেশের ৬৮ কারাগারে চিকিৎসকসহ জনবল সংকটের কথা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের কাছে চিঠি লেখেন। কিন্তু নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কারাগারে চিকিৎসক পদায়ন হয়নি।
ওই চিঠিতে বলা হয়, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ১, সিনিয়র কনসালট্যান্ট মেডিসিন ১, সিনিয়র কনসালট্যান্ট সার্জারি ১, জুনিয়র কনসালট্যান্ট অর্থোপেডিক ১, জুনিয়র কনসালট্যান্ট পেডিয়াট্রিক ১, জুনিয়র কনসালট্যান্ট গাইনি অ্যান্ড অবস ১, জুনিয়র কনসালট্যান্ট চর্ম ও যৌন ১, জুনিয়র কনসালট্যান্ট রেডিওলজি ১, জুনিয়র কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজি ১, জুনিয়ার কনসালট্যান্ট প্যাথলজি ১, জুনিয়র কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিক ১, আবাসিক চিকিৎসক মেডিসিন ১, আবাসিক চিকিৎসক সার্জারি ১, আবাসিক চিকিৎসক ইএনটি ১, আবাসিক চিকিৎসক গাইনি অ্যান্ড অবস ১, আবাসিক চিকিৎসক চক্ষু ১, রেজিস্ট্রার ১, সহকারী রেজিস্ট্রার ১, মেডিকেল অফিসার চর্ম ও যৌন ১, মেডিকেল অফিসার মেডিসিন ১, মেডিকেল অফিসার সার্জারি ১, মেডিকেল অফিসার ইএনটি ১, প্যাথলজিস্ট ১, রেডিওলজিস্ট ১, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ১, ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার ২, মেডিকেল অফিসার রক্তসঞ্চালন ১, মেট্রন ১ জনসহ মোট ৩২টি পদ সৃজন করা হয়।
এর বিপরীতে ওই কারা হাসপাতালে বর্তমানে একজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডেন্টাল সংযুক্তি আদেশবলে কর্মরত। ফলে কারাবন্দি ও স্থানীয় জনসাধারণের আউটডোর চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সরকারি অর্থে ক্রয়কৃত চিকিৎসা সামগ্রীও বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
এছাড়া ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০ জন সহকারী সার্জনের চাকরি সুরক্ষাসেবা বিভাগে ন্যস্ত করা হলেও তাদের মধ্যে কেবল চারজন পদায়নকৃত কর্মস্থলে যোগদান করেন এবং বাকি ১৬ জন অদ্যাবধি কর্মস্থলে যোগদান করেননি। এ বিষয়ে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয় বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
southeast
এছাড়া চলতি বছরের ২৮ মে স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপার পঙ্কজ ভট্টাচার্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিব বরাবর এক চিঠিতে বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি, শীর্ষসন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গি সদস্যসহ প্রায় ১১ হাজার বন্দি আছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য কারাভ্যন্তরে সুরমা ওয়ার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে মোট ১৭২টি শয্যা আছে।
ওই সময় সেখানে ৬২ জন বন্দি চিকিৎসার জন্য ভর্তি ছিলেন। এখানে স্থায়ীভাবে দুজন সহকারী সিভিল সার্জন রয়েছেন। আরেকজন সহকারী সার্জন ডেন্টাল সপ্তাহে তিনদিন কেরানীগঞ্জ ও অন্যদের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে কারাবন্দিদের চিকিৎসাসেবা দেন। যদিও কারা হাসপাতালে সরকারি সিভিল সার্জনের পাঁচটি অনুমোদিত পদ আছে। এছাড়া কারা হাসপাতালে একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন ডিপ্লোমা নার্স রয়েছেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে আগত রোগীদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি ও বাইরে থেকে আগত অসুস্থ বন্দিদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা উল্লিখিত সিভিল সার্জন ফার্মাসিস্ট ডিপ্লোমা নার্স দ্বারা হয়ে থাকে। গুরুতর অসুস্থ বন্দিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা শহরে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। বাইরের হাসপাতালে অসুস্থ বন্দিদের ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। ওই সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি বন্দির সংখ্যা ছিল ২৩ জন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নয় মাস আগে চিঠি দেয়া হলেও এতদিনে টনক নড়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের। গত ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের পক্ষে পরিচালক প্রশাসন ডা. শহীদ মোহাম্মদ সাদিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, কারাবন্দিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ইচ্ছুক চিকিৎসকদের কাছ থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।