স্টাফ রিপোর্টার: আজ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। এ দিনটি বাঙালি জাতির গৌরবের দিন, আনন্দের দিন। পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন এটি। পরাধীনতার শৃংখল মুক্তির অদম্য আকাঙ্খায় উদ্দীপ্ত কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন- ‘এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে…।’ তারও অনেক আগে দুর্দান্ত সাহসী কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন- ‘স্বাধীনতাহীনতায়/কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়/দাসত্ব শৃংখল বল/কে পরাবে পায় হে কে পরাবে পায়।’
নিত্যদিনের মতো স্বাধীনতা দিবসে ভোরের সূর্যালোকের বর্ণচ্ছটায় রাঙাবে কৃষ্ণচূড়া, গ্রামীণ পথের শেষে নদীর তীরে অশ্বত্থ শাখা থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান, শ্যামল প্রান্তরের দূর-দূরান্ত থেকে বাজবে রাখালিয়ার মনকাড়া বাঁশির সুর, নীল আকাশের বুকে ডানা মেলবে উড়ন্ত বলাকার ঝাঁক, কলকাকলিতে মুখরিত হবে জনপদ। তবুও অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে এ দিনটি আলাদা, ভিন্ন আমেজের, ভিন্ন অনুভূতি ও ভিন্ন স্বাদের। জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে গৌরবের স্মৃতি নিয়ে আবারও ফিরে এসেছে চির অম্লান, আনন্দ-বেদনায় মিশ্রিত সেই দিন। মৃত্যুপণ লড়াই ও রক্তসমুদ্র পাড়ি দিয়ে যে দিন বীর বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল জাতীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন-স্বাধীনতা। স্বাধিকার আদায়ের দৃঢ় মনোবল নিয়ে পশুশক্তিকে পরাজিত করে ঘোর অমানিশা কাটিয়ে বাংলার চিরসবুজ জমিনে রক্তে রাঙানো লাল-সবুজ পতাকার ভ্রুণ জন্ম নেয় ঐতিহাসিক দিনটিতেই। সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দু’শ বছরের ব্রিটিশ-বেনিয়া শাসনের অবসানের পর ২৪ বছর ধরে বাঙালিকে সইতে হয়েছিল বিজাতীয় ভাষা, গোষ্ঠীর শাসন ও শোষণ। পরাধীনতার ওই শৃংখল ভেঙে এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার মানুষের স্বপ্ন-সাধ ও কাঙ্খিত স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সূচনা ঘটে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও পটভূমি। একদিনের ঘোষণায় বা কারও বাঁশির শব্দ শুনে গোটা জাতি জীবনবাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। অদ্ভুত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসকদের অনাচার-অত্যাচার-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির রক্ত সংগ্রামের চেতনার উšে§ষ ঘটতে থাকে। মাতৃভাষার দাবিতে সেই ’৪৮ সাল থেকে শুরু করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তদান সংগ্রাম-আন্দোলন, ’৫৪-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিমলীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জাতির রায়, ’৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তি সনদ ঘোষণা, ’৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন এবং ১৯৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরংকুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এসেছে স্বাধীনতা। ’৭০-এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হন। এতে করে অর্জন করলেন সাংবিধানিকভাবে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- উচ্চারণের ভেতরেই মূলত বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের সবুজ সংকেত পেয়ে যায়। খুঁজে পায় গেরিলাযুদ্ধের গোপন কৌশল ও করণীয় সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা। এরপর জাতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সমগ্র জাতি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালির রক্তের বন্যায় ভেসে যায় পাকিস্তানের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার বাহিনীর দু’লক্ষাধিক সদস্যের নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’। সমগ্র মুক্তিকামী বিশ্ব ও জনতার আকুণ্ঠ সমর্থনে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই পৃথিবীর মানচিত্রে আরও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটল যার নাম বাংলাদেশ।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত দিনটি গোটা জাতির কাছে প্রাণের উচ্ছ্বাসে আপ্লুত হওয়ার দিন। একদিকে হাজার বছরের স্বপ্ন পূরণের সুখ ও আনন্দ, অপরদিকে স্বজন হারানোর ব্যথা-বেদনার এক আবেগঘন মিশ্র পরিবেশের মধ্য দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও মুক্তিকামী লাখো মানুষ নানা ব্যঞ্জনায় পালন করবে স্বাধীনতা দিবস। আজকের এ দিনে ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব স্মৃতির মিনার। হৃদয়পটে সৃষ্ট গভীর ক্ষত থেকে উচ্চারিত হবে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’।