কে. এম. বাবর আশরাফুল হক ও খান নাফি হক:
সৎ, নির্লোভ বহুমাত্রিক কৃতিত্বের অধিকারী একজন আলোকিত মানুষ, যিনি সারা জীবন অসহায় মানুষ ও সমাজের জন্য নীরবে-নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। সমাজকে আলোকিত করার এক মহাকর্মযজ্ঞে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন সারাটি জীবন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ সাদা মনের মানুষটির নাম মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডা. আবদুর রহমান খান (সংক্ষেপে ডাক্তার এ আর খান)। সব শ্রেণির মানুষকে আপন করে নেয়ার গুণ রয়েছে তার মধ্যে। তিনি সকলের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন খোলা মনে। প্রচুর অর্থ অর্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা অবলীলায় উপেক্ষা করেছেন। অধ্যাপক এ, আর, খানের জীবনের একমাত্র ব্রত দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করা। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ইস্পাতসম। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী অথচ নৈতিকতায় দৃঢ়। নীতির প্রশ্নে তিনি আপোষহীন। মনুষ্যত্বই তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। তিনি এক বিবেকবান মহীরূহ।
বিরল গুণসম্পন্ন এ মানুষটির সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো ও আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। মেজর জেনারেল (অব.) ডা. আবদুর রহমান খানের পিতা মরহুম আবদুল মজিদ খান, মাতা মরহুমা শরিফুন্নেছা খাতুন। ঢাকা জেলার দোহার থানার শাইনপুকুর গ্রামে ১৯২৮ সালের ১লা জানুয়ারি (সার্টিফিকেট অনুযায়ী) জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের হাতে লেখা ডায়েরি থেকে জানা যায় বঙ্গাব্দ ১৩৩২ সালের ১৩ই ফাল্গুন বুধবার দিবাগত রাত ১টায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষা জীবনের প্রথম হাতেখড়ি মায়ের কাছে পরবর্তীতে নেজাম উদ্দিন মুন্সী বাসায় পাঠ প্রদান করেন। তিনি শ্রীনগর থানার বাঘরা-স্থিত স্বরূপচন্দ্র হাইস্কুলে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৪৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমডিয়েট পরীক্ষায় পাস করে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করেন। ইন্টার্নি ডাক্তার হিসাবে কাজ করার পর ১৯৫১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান আর্মি মেডিকেল কোরে কমিশনান্ড অফিসার হিসাবে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে মেডিসিনে উচ্চ শিক্ষার জন্য ডেপুটেশনে যুক্তরাজ্য গমন করেন এবং ১৯৬৪ সালে গ্লাসগো এবং লন্ডন থেকে এম.আর.সি.পি ডিপ্লোমা নিয়ে দেশে ফেরেন। চাকরি জীবনে তিনি ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, শিয়ালকোর্ট, মুলতান এবং কোয়েটাতে বিভিন্ন হাসপাতালে মেডিকেল স্পেসালিস্ট হিসাবে কাজ করেন। ১৯৭২-১৯৭৩ সাল কোহাট এবং মান্ডিবাহাউদ্দিনে বন্দি জীবন যাপন করেন। ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকাতে সিনিয়র ফিজিসিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ডাইরেক্টর মেডিকেল সার্ভিস (আর্মি) পদাভিসিক্ত হন এবং ব্রিগেডিয়ার র্যাংকপ্রাপ্ত হন। ১৯৮১ সালে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল সার্ভিসের ডাইরেক্টর জেনারেল হিসাবে যোগদান করেন এবং মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি সামরিক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির বারডেম হাসপাতালে ডাইরেক্টর জেনারেল এবং চিফ কনসালটেন্ট ফিজিসিয়ান হিসাবে যোগদান করেন এবং বারডেম-এর ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯২ সালে বারডেমের কর্মপরিধি বিস্তৃত হয়ে গেলে বারডেমের ডাইরেক্টর জেনারেল পদের দায়িত্ব ছেড়ে দেন তবে চিফ কনসালটেন্টের পদে বহাল থাকেন। একই সঙ্গে তিনি ডায়াবেটিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। উপরোক্ত দুই পদে তিনি ২০০৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। বর্তমানে তিনি বারডেমের চিফ কনসালটেন্ট, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের সম্মানিত প্রফেসর অব ইন্টারনাল মেডিসিন, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির এফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং ইয়াং ডায়াবেটিক ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিয়াসন-ফেলো নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে তিনি রয়েল কলেজ অব ফিজিসিয়ান অব লন্ডনের ফেলোতে অভিসিক্ত হন। জেনারেল আবদুর রহমান খান বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের আজীবন সদস্য। অধ্যাপক ডা. খান ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি বাংলাদেশ রেডক্রস এবং রেড ক্রিসেন্টের আজীবন সদস্য এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। হিউম্যান ডেভলাপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামক একটা সেবামূলক সংস্থারও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কাদেরিয়া ফাউন্ডেশন নামে একটি সমাজ কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান। অধ্যাপক খান আবদুর রাজ্জাক-গুলশান আরা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। ওই প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তিনি নিজ গ্রামে ৩০ বেডের একটা পাঁচ তলা (অ-লাভজনক) হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ঢাকার ইন্দিরা রোডে গরিব ছেলে-মেয়েদের জন্য একটা অবৈতনিক স্কুল (ক্লাস এইট পর্যন্ত) চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মমতাজ ফাউন্ডেশন নামে একটা দাতব্য ফাউন্ডেশনের ট্রেজারার। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে গরিব রোগীদের গাইনি অপারেশন বিনামূল্যে করা হয়ে থাকে। ডা. খান আবদুল মজিদ খান-শরিফুন্নেছা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সভাপতি। তিনি বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির আজীবন সদস্য, লিভার ফাউন্ডেশনের আজীবন সদস্য। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মহিলা ও শিশুদের চিকিৎসার জন্য একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আরিয়ল বিল মা-ও-শিশু ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা গঠন করেছেন। তিনি ঢাকার আজিমপুর কলোনির লিটল এনজেলস নামক একটা স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। উল্লেখ্য, ১৯৭২-৭৩ সালে পাকিস্তানের মান্ডিবাহাউদ্দিনের বন্দি শিবিরে থাকাকালীন সময়ে আটকেপড়া বাঙালিদের পরিবারের চিকিৎসা দেয়ার জন্য তিনি একটা স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা খুলেছিলেন যার মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হতো। এ ছাড়া যে সকল পরিবার আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তাদের আর্থিক ঋণ দেয়ার লক্ষ্যে একটা কল্যাণ সমিতি গঠন করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন সেই কমিটির সম্পাদক ও ট্রেজারার।
অধ্যাপক খান আরো কয়েকটি সেবা ও সমাজকল্যাণ মূলক কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন। ১৭ বছর আগে ঢাকায় তার আবাসিক এলাকা ডিওএইচএস-এ একটি ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক চালু করেছেন। এটা এখনও চলছে। নিজের গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কয়েকটি রাস্তা পাকা করতে সফলকাম হয়েছেন। গ্রামের লোকজনের সহায়তায় সেখানে পদ্মা মহাবিদ্যালয় নামে একটা কলেজ স্থাপন করেছেন। তিনি উক্ত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গ্রামে দারিদ্র্য দূরীকরণ সংস্থা নামে একটা সমাজ কল্যাণ সংস্থা স্থাপন করেছেন, তিনি এর সভাপতি। তিনি তিন বছর গ্ল্যাক্সো ফারমাসিওটিক্যালের চেয়ারম্যান ছিলেন। অধ্যাপক আবদুর রহমান খান ৯ বছর আইএফআইসি ব্যাংকের ডাইরেক্টর ছিলেন। তিনি লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা প্রমিনেন্টের সভাপতি ছিলেন। ডা. খান বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন- এর মধ্যে পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভারত, ইরান, মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্পেন, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, লুক্সেমবার্গ, ইতালি, ফ্যান্স, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র , কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, হংকং, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান এবং মেক্সিকো।
অধ্যাপক খান তিনবার হজ এবং চার বার ওমরাহ হজ পালন করেছেন।
১৯৯৬ সালে ডাক্তার খান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কেয়ার-টেকার গর্ভমেন্টের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি মৌলানা আকরাম খান স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক এবং ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক লাভ করেন।
অধ্যাপক ডা. এ আর খান সম্বন্ধে শ্রুত আছে যে, তার শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া-প্রতিবেশীর বিপদে স্থির থাকতে পারেন না, ছুটে যান সবার আগে। তিনি অসহায়, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের শুধু বিনে পয়সায় চিকিৎসা সেবাই দেন না বরং অসচ্ছলদের ওষুধ কেনার টাকাও দিয়ে দেন। সমাজের অসহায় ও নিরন্ন মানুষদের সাহায্য করেন গোপনে।
আলাপচারিতায় মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডাক্তার এ আর খানের কাছে তার ছোটবেলা সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সময় টেলিভিশন, কম্পিউটার গেমস্ ইত্যাদি আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না সত্য কিন্তু আমাদের বাল্যকাল যে বিষাদময় ছিল তাও নয়। তখনকার বাবা-মা মনে করতেন ছেলেদের অবসর সময়ে চিত্তবিনোদন তাদের নিজেদের ব্যাপার। তাদেরকে ফ্রি ছেড়ে দিলে তারা নিজেদের পছন্দমতো ব্যবস্থা করে নেবে। বাস্তবেও তাই হতো। ছেলেমেয়েরা নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকল্প নিত যেমন- কাগজ ভাঁজ করে নৌকা বানিয়ে পানিতে ছেড়ে দেয়া, কাগজ ভাঁজ করে এরোপ্লেন বানিয়ে আকাশে ছুড়ে মারা। তেতুল বিচি সংগ্রহ করে জোড় বিজোড় খেলা, মাটিতে ছক কেটে অথবা কাঠের বেঞ্চে ছক কেটে ষোলগুটি বাঘ চাল খেলা, জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে খেলা, পিটকিলা (দৌলা) গোটার মাঝে নারিকেলশলা দিয়ে লাটিম বানিয়ে খেলা, গাছের ডাল ণ আকারের কেটে রাবারের ব্যান্ড লাগিয়ে গুলটি বানিয়ে পাখি শিকারের চেষ্টা করা। পুকুরপাড় থেকে এটেলমাটি এনে গোল করে মাটির বল তৈরি করে রোদে শুকিয়ে চুলার আগুনে পুড়িয়ে গুলটির গুলি হিসেবে ব্যবহার করা, সরু বাঁশের টুকরা দিয়ে বন্দুক বানিয়ে হিজলের গোটা থেঁথলিয়ে বন্দুকের গুলি বানানো, আমের আঁটি দিয়ে ভেপু বানিয়ে বাঁশির কাজ করা হতো অথবা গাছের পাতা দিয়ে বাঁশি বানানো হতো। তিল ফুলে মধু খাওয়া অবস্থায় ফড়িং এবং মৌমাছি ধরে সুতা বেধে উড়িয়ে দিয়ে মজা করা হতো। বর্ষায় সাঁতার কেটে নৌকা বিহার করা হতো, শুকনো মৌসুমে খেতের ফসল দেখা, গাছের ফল দেখা, খেজুর গাছের রশ বের করা দেখা, পাখির গান শুনা ইত্যাদি প্রকৃতির সাথে সখ্য গড়ে তোলার আনন্দ কম্পিউটার গেমস্ থেকে কোন অংশে কম ছিল না।
ডাক্তার হওয়ার পেছনে কার অনুপ্রেরণা কাজ করেছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন সে সময় অর্থাৎ ১৯৩০-এর দশকে তাদের গ্রামে বা আশপাশের গ্রামে কোন ডাক্তার ছিল না। আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কারো ফোঁড়া হলে তার মা-ই সেসব অপারেশন করতেন। এসব দেখে তখন থেকে ডাক্তার হওয়ার একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া ডাক্তার হতে মায়ের অনুপ্রেরণাতো ছিলই।
সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে কিভাবে আগ্রহী হলেন, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্বে তার ইচ্ছা ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানি আমলের সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (CSP)তে যোগদান করার। কিন্তু এরই মধ্যে তার এক বন্ধু এসে খবর দিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে লোক নিচ্ছে। এদিকে (CSP)তে যোগ দিতে হলে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হতো। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর PNG ব্যাটালিয়ানে সরাসরি ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পূর্বে পরিবার থেকে আপত্তি তোলা হয় এই বলে যে, সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে সেখানে মদ খেতে হয়। তবে আমি (জেনারেল এ আর খান) যখন সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে সেখানে হয়তো কেউ কেউ মদ খেয়ে থাকতে পারে, তবে সবাই মদ খায় না। আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে পরিবার থেকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে আর কোন বাধা থাকলো না। দীর্ঘ সেনা জীবন সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেনাজীবন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। আমি সেনাজীবনকে খুব পছন্দ করি। সেনাজীবন খুব পরিচ্ছন্ন একটি জীবন। এখানে কোন অনিয়ম নেই। কোন রকম ঘুষ বা দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীতে যে সব সুযোগ-সুবিধা ও বেতন পাওয়া যায় তাতে প্রাচুর্য না থাকলেও সৎ, সুস্থ, স্বাচ্ছন্দ্যময়, সুশৃঙ্খল ও সুন্দরভাবে জীবন যাপন করা যায়। তিনি বলেন, জীবনে আবারো যদি কখনো সুযোগ পেতাম তবে আমি (জেনারেল এ আর খান) সেনাজীবনকেই বেছে নিতাম।
মেজর জেনারেল ডাক্তার এ আর খানের দীর্ঘ ডাক্তারি পেশাজীবনের কিছু দুঃখ ও আনন্দ সম্বন্ধে জানাতে অনুরোধ করলে ডাক্তার খান বলেন, কোন মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে পারলে বড়ই তৃপ্তি ও আনন্দ পেয়েছি। যখন কোন ক্যান্সার বা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত কোন রোগীকে আপ্রাণ চেষ্টা করেও সুস্থ করতে পারিনি তখন খুব কষ্ট পেয়েছি। অনেক সময় দুরারোগ্য রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা জায়গাজমি বিক্রি করে তাদের রোগীকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়, রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।
কর্মজীবনে থেকেই আপনি বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। কিভাবে আপনি এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডাক্তার খান বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই তার মানুষের সেবায় নিজেকে কাজে লাগানোর একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। চাকরি জীবনে সাধ্য অনুযায়ী আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের বিনামূল্যে সেবা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। কারো অসুস্থতার খবর পেলে ছুটে গিয়েছেন তাদের কাছে। কিভাবে আরো বেশি মানুষকে আমার (ডাক্তার এ আর খান) সেবার আওতায় আনা যায় সব সময় সে চিন্তাই করতাম। এ চিন্তা থেকেই অবসর নেয়ার আগে আমি বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার ইব্রাহীমের সঙ্গে দেখা করি। তাকে বলি সাধারণ মানুষের সেবায় আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। এ কথা শুনে অধ্যাপক ডাক্তার ইব্রাহীম খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন আপনি এলে তো আমি কৃতজ্ঞ থাকবো; তবে আপনাকে তো আমি উপযুক্ত সম্মানী দিতে পারবো না। আমি বললাম আমার কোন টাকা-পয়সার প্রয়োজন নেই। আমার কথা শুনে ইব্রাহীম সাহেব খুশি হয়ে বললেন তাহলে আজকেই কাজ শুরু করেন। আমি (অধ্যাপক এ আর খান) বললাম আমিতো হজে যাচ্ছি, হজ থেকে ফিরেই বারডেমে যোগ দিব। হজ থেকে ফিরে বারডেমের ডাইরেক্টর জেনারেল এবং চিফ কনসালটেন্ট ফিজিশিয়ান হিসেবে ১৯৮৫ সালে যোগদান করি। তারপর ডায়বেটিক সমিতির সদস্য হই এবং কিছুদিন ট্রেজারার হিসেবেও কাজ করি। বর্তমানে চিফ কনসালটেন্ট ফিজিশিয়ান ও ডায়বেটিক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। তাছাড়া আমার ইচ্ছা ছিল আমার গ্রামে চিকিৎসাসেবা দেয়া; সে জন্য আমি প্রথম থেকেই সপ্তাহে একদিন গ্রামে গিয়ে রোগী দেখতাম এবং সে প্র্যাকটিস এখনো আমি বজায় রেখেছি। গ্রামে গিয়ে রোগী দেখার পাশাপাশি গ্রামে কিছু হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করি। আমার উদ্যোগে একটি হেলথ ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এছাড়া আমাদের গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের যৌথ মালিকানার একটি জায়গায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করি। নিউএজ গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের সহায়তায় আবদুর রাজ্জাক গুলশান আরা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নিজ গ্রামে একটি পাঁচতলা (অলাভজনক) হাসপাতাল করি। সেখানে আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজিসহ আরো পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এখানে প্রায় সব রকম অপারেশন হয়। এ হাসপাতাল ছাড়াও আমাদের গ্রামের পাশে মৌরা এলাকায় বিলের পাশে আরো একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি। এছাড়াও মৌরা এলাকায় একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছি।
আপনি তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। কিভাবে এবং কখন জানতে পারলেন আপনি উপদেষ্টা হচ্ছেন। এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক এ আর খান বলেন, তখন তিনি গ্রীণ সুপার মার্কেটের চেম্বারে রোগী দেখতেন। একদিন সন্ধ্যায় রোগী দেখছেন এমন সময় একটি ফোনকলের মাধ্যমে জানতে পারেন তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেও সবার অনুরোধে তিনি রাজি হন।
আপনি তো একজন সফল মানুষ। সারা জীবন সমাজ ও মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তারপরও কি মনে হয় আরো কিছু করার আছে। এমনটা জানতে চাইলে অধ্যাপক এ আর খান জানান, কিছু কিছু কাজ এখনও করার আছে। প্রথম থেকেই দরিদ্রদের জন্য আমার (ডাক্তার এ আর খান) কিছু করার ইচ্ছা ছিল। কিভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণ করা যায়। ব্যুরো বাংলাদেশ নামে একটি সংস্থা ছিল সেটা কিছুদিন চালানোর পর অনেক টাকা-পয়সা বেহাত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে রেজিস্ট্রি করে একটি সংস্থা চালু করি এর নাম দারিদ্র্য দূরীকরণ সংস্থা। যার মাধ্যমে গ্রামে নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছি। মূলত এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়েই আমি ব্যস্ত রয়েছি। এ সংস্থার মাধ্যমে মেয়েদের সেলাই মেশিন দিচ্ছি। গরু-মহিষ লালন পালনের জন্য বিনা সুদে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে সেনেটারি ল্যাট্রিন করে দিচ্ছি। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া একটা খেলার মাঠ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। কারণ এ গ্রামে খেলাধুলা করার কোনো মাঠ নেই। খেলাধুলা ছাড়া স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। খেলাধুলা না করলে ডায়বেটিস, ব্লাড পেসারসহ নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়। এর সঙ্গে একটি পার্ক প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সেখানে নানা ধরনের গাছ লাগানো হচ্ছে। আর বয়স্ক যারা খেলতে পারেন না তাদের হাঁটার ও ব্যায়াম করার জন্য একটি ওয়াকিং ট্র্যাক করার ইচ্ছা রয়েছে। মহান করুণাময় আল্লাহতায়ালা যদি আরো দুটি বছর হায়াত দেন তবে এটা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা করি। ইতিমধ্যে আমার প্রতিষ্ঠা করা পদ্মা কলেজটি ডিগ্রি কলেজে উন্নীত এবং এটা বর্তমানে সরকারি করা হয়েছে। মেজর জেনারেল ডাক্তার আবদুর রহমান খানের ব্যক্তি জীবন সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার স্ত্রী মাহমুদা খান এলাকার মহিলা সমিতির সভানেত্রী ছিলেন ও একটি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল চালাচ্ছেন। বড় ছেলে মাহ্মুদুর রহমান খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার। ছোট ছেলে ডাক্তার মাহ্বুবুর রহমান খান ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসক এবং কন্যা ইকোনমিস্ট ফাহ্মিদা রহমান খান, বর্তমানে কানাডায় কর্মরত রয়েছেন। ডাক্তার খানের ভালো লাগা, মন্দ লাগা সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো একটা ভালো কাজ করতে পারলে ভালো লাগে আর সব মন্দ কাজই খারাপ লাগে।
আলাপচারিতা শেষে আলোকিত এ প্রজ্ঞাবান মানুষটির সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করে বিদায় জানাই। তিনিও আমাদের ধন্যবাদ জানান।