আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা উন্নত হব, শিল্পায়নে যাব। কিন্তু কৃষককে ত্যাগ করে নয়, কৃষিকে ত্যাগ করে নয়। কারণ কৃষি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, খাদ্য দেয়, পুষ্টি দেয়- সবকিছু করে। কাজেই আমাদের দেশে উন্নয়ন প্রকল্পটা আমরা এমনভাবে নিই, যাতে কৃষকদের আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী কৃষক লীগের দশম ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিন বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনস্থলে পৌঁছলে সারা দেশ থেকে আসা কৃষক লীগের কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা স্লোগান দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। পরে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় পতাকা এবং কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শান্তির প্রতীক পায়রা এবং বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
মঞ্চে ওঠার পর প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিদের সম্মেলনের ব্যাজ পরিয়ে দেয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী কৃষক লীগের প্রকাশনা ‘কৃষক কণ্ঠ’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন। কৃষিবিদ সমীর চন্দ্রের পরিচালনায় সম্মেলনের শুরুতেই বিশিষ্ট শিল্পী মলয় গাঙ্গুলীর কণ্ঠে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’ গানটি পরিবেশন করা হয়। এরপর কৃষক লীগের দলীয় সঙ্গীত এবং বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনায় গীতিনাট্য পরিবেশন করা হয়।
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দেশের উন্নয়ন ও অর্জনের ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে হবে। বিএনপির সময় সারের জন্য গুলি খেয়ে ১৮ জন কৃষককে জীবন দিতে হয়েছে। এখন আর কৃষককে জীবন দিতে হয় না। এখন সার কৃষকের হাতে পৌঁছে যায়।
দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের এক ইঞ্চি জায়গাও যেন অনাবাদি পড়ে না থাকে। কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমরা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছি। শিল্পকারখানা করার দরকার হলে সেখানে আমরা প্লট দিয়ে দেব। তিন ফসলি জমিতে কখনোই শিল্পকারখানা না। আমাদের কৃষিজমি বাঁচাতে হবে, মানুষকে খাওয়াতে হবে। আর খাদ্য চাহিদা কোনো দিন শেষ হয় না। জনসংখ্যা বাড়বে, খাদ্যের চাহিদাও বাড়বে। কাজেই একটি দেশের জন্য, একটি সমাজের জন্য কৃষি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উন্নয়ন এখনও অনেকাংশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষিজমি নষ্ট করে কোনো স্থাপনা বা শিল্পকারখানা করা যাবে না।
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণে সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার কৃষকবান্ধব। কৃষকের অধিকার রক্ষা করাই আওয়ামী লীগ সরকারের মূল লক্ষ্য। কৃষকের কল্যাণে আমরা ক্ষমতায় আসার পর নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। যার ফলশ্রুতিতে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। আজ দেশ খাদ্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, উদ্বৃত্তের দেশ। আমাদের কারও কাছে খাদ্যের জন্য হাত পাততে হয় না। তাই ধান কাটা, ধানের চারা রোপণ করা, জমি চাষ- কৃষির সবকিছুকে যান্ত্রিকীকরণ করার ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে তা অবশ্যই কৃষিজমি রক্ষা করে। এ দেশ ফুলে-ফসলে ভরা। আরও সুন্দরভাবে আমরা এ দেশকে গড়ে তুলতে চাই।
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কৃষকের কাচারি ঘরের আদলে ৯০ ফুট দীর্ঘ ও ৩০ ফুট প্রস্থের সম্মেলন মঞ্চ তৈরি করা হয়। মঞ্চের পাশে রাখা ছিল ‘আমার বাড়ি-আমার খামার’ স্লোগানের একটি মডেল। কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রি করছেন- এমন দৃশ্য মডেলের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। রাস্তার চারপাশে লাগানো হয়েছে বাঁশবাগান, ফলদি ও ঔষধি গাছ। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন মঞ্চে ওঠার আগে দৃষ্টিনন্দন এসব মডেল পরিদর্শন করেন।
পড়াশোনা শিখলে কৃষিজমিতে কাজ করতে যেতে অনেকের অনীহার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমাদের একটা সমস্যা আছে। আমাদের যারা লেখাপড়া শেখে, লেখাপড়া শিখলেই তারা মাঠে যেতে চায় না। কৃষকের ছেলে, বাবা কৃষিকাজ করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাই অবশ্যই সবার মাঠে যাওয়া উচিত। যাবে না কেন? কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য- দুই পাতা পড়লেই মনে করে আমি কেন মাঠে যাব? আমার মনে হয়, এই চিন্তা থেকে সবার দূরে থাকা দরকার। সে কারণে এবার ধান কাটার সময় আমাদের ছাত্রলীগকে বলেছিলাম- ‘তোমরা ধান কাটতে চলে যাও। কৃষকদের পাশে দাঁড়াও। এতে লজ্জার কিছু নেই। নিজের কাজ নিজে করা লজ্জার কিছু থাকে না। নিজে খাদ্য উৎপাদন করব, নিজের খাবার নিজে খাব- এখানে লজ্জার কী আছে?
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কোনো কাজে লজ্জার কিছু নেই, সব কাজ করার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে। আমি বলেছি, প্রয়োজনে আমিও যাব। আমি আমার গ্রামে বলে রেখেছি, তোমরা যখন ধান কাটবে বা বীজ রোপণ করবে তখন আমায় বলবে, আমি যাব। আমার এতে কোনো লজ্জা নেই। শিক্ষিতদের কৃষিকাজে অনীহা দূর করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই জায়গাটায় আমাদের কৃষক লীগের একটা ভূমিকা থাকা দরকার। আমি মনে করি, আমদের স্কুলজীবন থেকে এটা আমাদের অভ্যাস থাকা দরকার। তিনি বলেন, ছোট বাগান করা, জমি চাষ করা বা সেখানে ফসল উৎপাদন করে নিজের ফসল ঘরে তোলা- এটা তো গর্বের বিষয়। তাই এটাকে এভাবে দেখতে হবে, কৃষিকে মর্যাদা দিতে হবে। মর্যাদা না দিলে নিজের পেটের ভাত আসবে কোথা থেকে?
কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে জাতীয় সম্মেলনে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সংগঠনের দফতর সম্পাদক নাজমুল ইসলাম পানু। এরপর ১৫ আগস্টসহ সব শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন অভ্যর্থনা উপকমিটির আহ্বায়ক শরীফ আশরাফ আলী। সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খন্দকার শামসুল হক রেজা। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও ভারতের সর্বভারতীয় কৃষান সভার সাধারণ সম্পাদক অতুল কুমার অঞ্জন। সম্মেলনে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের পর দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে নতুন কমিটি নির্বাচন করা হয়। এতে সভাপতি পদে সমীর চন্দ্র চন্দ ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উম্মে কুলসুম স্মৃতি নির্বাচিত হয়েছেন।
কৃষির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সবসময়ই কৃষিকে গুরুত্ব দিই। ভবিষ্যতেও কৃষির উন্নয়নে যা যা করণীয় সবই করা হবে। কৃষকদের যত ধরনের সুবিধার প্রয়োজন হয় তা দেয়া হবে। কৃষিতে ভর্তুকি প্রদানে বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি দাতা সংস্থার বাধা প্রদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের (বিশ্বব্যাংক) বলেছি, আপনাদের টাকা লাগবে না, নিজের টাকা দিয়েই কৃষিতে ভর্তুকি দেব। আমরা তাই দিয়েছি। গত ১০ বছরে আমরা ৬৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছি। কারণ সবকিছুতেই সবসময় লাভ দেখলে হয় না। দেশের মানুষ কিসে উপকৃত হবে সেটা চিন্তা করতে হয়। আমরা সেভাবেই পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের দেশকে কীভাবে উন্নত করা যায়, আমরা সেভাবেই কাজ করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, কৃষকদের উন্নয়নে আমরা ব্যাপক কাজ করেছি। গত ১০ বছরে আমরা ৬৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষিতে বাজেট ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। আমরা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছি। এ ছাড়া ২ কোটি ১৩ লাখ কৃষককে উপকরণ কার্ড দিয়েছি। কৃষকরা মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পেরেছে। আমরা যে প্রণোদনা দিচ্ছি তা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি জমা হয়ে যায়। এ ছাড়া তারা ওই কার্ড দেখালে সেখান থেকে স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণ কিনতে পারবে- আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কৃষির জন্য বিদ্যুতেও ২০ ভাগ ভর্তুকি দিচ্ছি।
তিনি বলেন, যারা বর্গাচাষী তারা অন্যের জমি চাষ করে। নিজেদের কোনো জমি নেই। তারা ব্যাংক থেকে আগে কোনো ঋণ নিতে পারত না। আমরা কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে বর্গাচাষীদের জন্য বিনা জামানতে স্বল্পসুদে কৃষিঋণ দিতে শুরু করি। আমরা কৃষিতে ভর্তুকি দিই। আপনারা জানেন ’৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ ভাগ অঞ্চল পানির নিচে ছিল। বিদেশিরা বলেছিল, দুই কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। আমরা বলেছি, একটি মানুষও না খেয়ে মারা যাবে না। আমরা হাতে রুটি বানিয়েছি এবং হেলিকপ্টারে তা বিতরণ করেছি। এ ছাড়া পানি কমে গেলে এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বন্যাকবলিত এলাকায় সার ও বীজের চারা পৌঁছে দিয়েছি। যাতে কৃষকরা উৎপাদনে যেতে পারে।
দেশের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণার ওপর বর্তমান সরকার ব্যাপক জোর দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ফসলকে বহুমুখী করতে চাই। গবেষণা করে এ পর্যন্ত ১০৮টি ধানের জাত আবিষ্কার করতে পেরেছি। আয়রন ও জিংকসমৃদ্ধ চাল উৎপাদন করতে পেরেছি। আমি নিজেও সেই চাল খেয়ে দেখেছি। এ ছাড়া ৪৪২টি উৎপাদন প্রযুক্তি আমরা উদ্ভাবন করতে পেরেছি। কৃষকদের জন্য ই-কৃষি চালু করেছি। কৃষকরা ১৬১২৩ নম্বরে কল সেন্টারে ফোন করেই সব সমস্যার সমাধান পেয়ে যাচ্ছে। কৃষকরাও এখন এ ব্যাপারে পরিপক্ব হয়ে উঠেছে।
কৃষকের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। যেন কৃষক লীগের নেতারা কৃষকের কথা বলতে পারেন। কৃষি কাজে যারা ভালো ফল দেবেন, তাদের গবেষণা, কৃষি উৎপাদন ও উৎসাহ দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু তহবিল গঠন করেছিলেন। এই তহবিল থেকে কৃষিক্ষেত্রে অবদানের জন্য পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর এই পুরস্কার বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে আমরা ক্ষমতায় এসে আইন করে কৃষকদের জন্য পুরস্কার ও প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বিএনপিও ক্ষমতায় এসে বিএডিসি বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল বিএডিসি লাভজনক না। কিন্তু সবসময় সবকিছুতে লাভ-লোকসান দেখলে চলে না। দেশের মানুষ কীভাবে উপকৃত হবে সেটিই আমদের দেখতে হবে।