বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডির পিবিআই সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনোজ কুমার মজুমদার।
বনোজ কুমার বলেন, এই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত গড়ায় হত্যাকাণ্ডে। এজন্য শাহিন আর তার স্বামী বারডেম হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হাসান আলী চৌধুরী করেন একটি পরিকল্পনা। তাতে শাহিন যুক্ত করেন তার ভাই আনাস মাহমুদ ওরেফে রেজওয়ান। আর ডা. হাসান ভাড়া করেন তারই রোগীর ওই সময়ে শান্তিনগরের ক্যাডার মারুফ রেজাক। বেইলি রোডে প্রকাশ্যে খুন করা হয় সগিরা মোর্শেদকে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধামাচাপা ছিল হত্যাকাণ্ডটি। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে-শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে হত্যার রহস্য।
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই। প্রতিদিনের মত বিকেল ৫টায় মোসাম্মৎ সগিরা মোর্শেদ সালাম (৩৪) বাসা থেকে মেয়ে সারাহাত সালমাকে (ভিকারুননেসা স্কুলের ২য় শ্রেণির ছাত্রী) আনতে যায়। স্কুলের সামনে পৌঁছা মাত্রই অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা তার বালা টান দেয়, বালা দিতে অস্বীকার করলে তাকে গুলি করে। ভিকটিমকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। এই ঘটনায় তার স্বামী আ. ছালাম চৌধুরী রমনা থানায় একটি মামলা করেন। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মোট ২৬ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করে। কিন্তু অনুদঘাটিত থাকে রহস্য।
সেই রিকশাচালকের নাম ছালাম মোল্লা। বর্তমানে তার বয়স ৫৬ বছর। খুনের ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ২৬ বছর। ছালামের সামনে ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী সগিরা মোর্শেদ খুন হন।
খুনিদের চেহারা কেমন ছিল? কী কথা হয়েছিল খুনিদের সঙ্গে? কীভাবে সগিরা মোর্শেদকে খুন করা হয়? খুনের পর খুনিদের ধরার জন্য তিনি পিছু নিয়েছিলেন-এসব তথ্য ঢাকার আদালতকে চলতি সপ্তাহে বিস্তারিত জানান রিকশাচালক ছালাম মোল্লা।
গত ১১ জুলাই সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ক্রিমিনাল মিস মামলাটি খারিজ করে অধিকতর তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআই-এর ডিআইজিকে নির্দেশ দেয়।
পিবিআই এর তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম গত ১০ নভেম্বর মামলাটির সন্দেহভাজন আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে (৫৯) রামপুরা থেকে গ্রেফতার করেন। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক সন্দেহভাজন আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনকে (৬৪) ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার করেন। পরদিন মো. মারুফ রেজাকে (৫৯) বেইলী রোড তার বাসা থেকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতাকৃত চার জন আসামি ভিকটিম সগিরা মোর্শেদ হত্যায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি’র ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, সগিরা মোর্সেদ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৪)। আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) এবং আসামি মো. মারুফ রেজা পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যায় অংশ নেয়।
সার্বিক তদন্তে জানা যায়, বাদী আ. ছালাম চৌধুরী তিন ভাই। বড় ভাই সামছুল আলম চৌধুরী ও মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী। আ. ছালাম চৌধুরী ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। বাদী ও ভিকটিম সগিরা মোর্শেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে লেখাপড়া করার সময় পরস্পরের মধ্যে সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। আ. ছালাম ১৯৮০ সালে শিক্ষকতা করার জন্য সপরিবারে ইরাকে চলে যায়। ১৯৮৪ সালে বাদী সপরিবারে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তাদের ৩ কন্যা সন্তান রয়েছে।
অন্যদিকে হাসান আলী চৌধুরী বারডেম হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে কর্মরত। তিনি ১৯৮০ সালে সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনকে বিয়ে করেন। ২২ জুন ১৯৮০ সালে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে লিবিয়ায় চলে যান। তিনি ১৯৮৫ সালে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে ৯৫৫ আউটার সার্কুলার রোডের রাজারবাগে বাবার বাসায় তার মা, বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে নীচ তলায় থাকতেন। তারপর ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার ছোট ভাই আ. ছালাম চৌধুরীর বাসায় সপরিবারে থাকতেন।
এক বাসায় থাকার কারণে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী শাহিনের সঙ্গে আ. ছালাম চৌধুরীর স্ত্রী সগিরা মোর্শেদের গৃহস্থালির কাজের ব্যাপারে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। আনুমানিক ৬ মাস থাকার পর ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে ওই বাড়ির তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হলে ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার স্ত্রী পুত্রসহ তৃতীয় তলায় উঠেন। এই সময়ে তৃতীয় তলা হতে ময়লা ফেলা ও বিভিন্ন কারণে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী শাহিনের সঙ্গে সগিরা মোর্শেদের দ্বন্দ্ব হয়েছিল। ভিকটিম সগিরা মোর্শেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাশ ছিল আর শাহিনের সিম্পল বিএ পাশ ছিল। পারিবারিক তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী শাহিনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়।
১৯৮৯ সালের প্রথম দিকে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন বলেন, সগিরা মোর্শেদকে একটু শায়েস্তা করতে হবে। স্ত্রীর ওই কথায় ডা. হাসান আলী চৌধুরী রাজি হয়। আসামি মারুফ রেজা (তৎকালীন সময়ে সিদ্ধেশ্বরী এলাকার নামকরা সন্ত্রাসী এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর রোগী ছিল। সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য ডা. হাসান আলী চৌধুরী আসামি মারুফ রেজার সঙ্গে কথা হয়। এই কাজের জন্য ডা. হাসান আলী চৌধুরী মারুফ রেজাকে তৎকালীন ২৫ হাজার টাকা দেয়ার কথা ছিল। ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে মারুফ রেজার সহযোগী হিসাবে নিয়োগ করে, যাতে সে সগিরা মোর্শেদকে দেখিয়ে দিতে পারে। আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান, ডা. হাসান আলী চৌধুরীর বাসায় যাতায়াত করতো, এই সুবাদে সে সগিরা মোর্শেদকে চিনতো।
গত ২৫ জুলাই ১৯৮৯ ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে বেলা আনুমানিক ২ টার দিকে ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলে। মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসবে বলে জানায়। ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালককে মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরা মোর্শেদকে দেখিয়ে দিতে বলে। বিকাল ৪টার টার দিকে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান মারুফ রেজার মোটরসাইকেলের পেছনে উঠে মৌচাক মার্কেটের সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের গলি দিয়ে ঢোকে। তারা সগিরা মোর্শেদকে রিকশায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যেতে দেখে ফলো করে।
মারুফ রেজা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একটু আগে মোটরসাইকেল দিয়ে সগিরা মোর্শেদের রিকশায় ব্যারিকেড দিয়ে হাতের চুড়ি ধরে টানা হেঁচড়া করে। তখন সগিরা মোর্শেদ আসামি আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে চিনে ফেলে। পরে বলে ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি এখানে কেন?’। এই কথা বলার পরপরই মারুফ রেজা ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে সগিরা মোর্শেদকে পিস্তল বের করে গুলি করে হত্যা করে।