এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ:
কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্কে, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষা-দীক্ষা এ সবই সংস্কৃতি। তাই বলা হয়ে থাকে, কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে জানতে হলে তার সংস্কৃতির দিকে তাকালেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হচ্ছে, একটি জাতির বা রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি অন্য একটি জাতি বা রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেয়া। মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে আমরা অর্থনীতির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি যে আগ্রাসনের শিকার হচ্ছি তা হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আধুনিক সভ্যতার একটি বড় অভিশাপ। আজকাল সংস্কৃতি শব্দটির পাশে যোগ হচ্ছে আকাশ সংস্কৃতি। মূলত কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে টিভি চ্যানেলগুলোর বিশ^ব্যাপী প্রচারকেই আকাশ সংস্কৃতি বলা চলে। আর এটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অন্যতাম প্রধান হাতিয়ার।
আমাদের দেশে ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলগুলোর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় চল্লিশটির মতে ভারতীয় চ্যানেল দেখানো হয়। এর মধ্যে ত্রিশটি চ্যানেলের ভাষাই হিন্দি। এসব চ্যানেলে আমাদের শিশুরাও হিন্দিতে ডাবিং করা কার্টুন দেখে। এছাড়াও ভারতীয়রা তাদের সনাতন ধর্মের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিও কার্টুনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে শিশু-কিশোরদের মধ্যে। এখনকার শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘ডোরেমন’। এই কার্টুনটি দেখে আমাদের কোমলমতি শিশুরা কি শিখছে? তারা শিখছে যে, কী করে অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে নিজের কৃতিত্ব জাহির করা যায় এবং অল্প পরিশ্রমে কী করে নাম-যশ কামানো যায়। আর সেই নাম-যশ দ্বারা কীভাবে ভালো লাগার মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়। বিউটি পার্লার তথা সৌন্দর্যশিল্পেও এর প্রভাব লক্ষ করার মতো। হিন্দি সিরিয়াল ও নায়িকাদের মতো ফিগারের প্রতি এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে সমাজে। এছাড়াও মেয়েদের দাঁত, ত্বক ও নখের সৌন্দর্য বর্ধনে বিউটি পার্লারে চলছে নানা কসরত। এসবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণে চলছে নানা ধরনের প্রচারণাও। তবে বাস্তবতা হলো অন্ধ অনুকরণ ও অবৈজ্ঞানিক চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই হিতে-বিপরীত ফল লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিবেশী দেশের টিভি সিরিয়াল আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ নেশার মতো। নেশা যেমন একটি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। ঠিক তেমনি সাংস্কৃতির আগ্রাসনও একটি দেশেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়। এটা অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের পারিপাশির্^ক ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করে। সিরিয়াল নাটকগুলো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিবার প্রথাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। এমনকি খুন-খারাবি বা অবৈধ প্রেমকে উৎসাহ বা সংসার ভাঙ্গার ঘটনার সংবাদ পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। আমাদের সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতির ভোগবাদ, পোশাক-পরিচ্ছদ, অশ্লীলতা আর বেলেল্লাপনার মহোৎসব শুরু হয়েছে। যে কারণে বাড়ছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বিবাহ-বিচ্ছেদ, অনৈতিক জীবন যাপনের অন্ধকারময়তার বিকৃত অনাচার। সমাজের মধ্যে এইসব নেতিবাচক পরিবর্তন বাতাসের গতিকেও হার মানায়। আর এভাবেই নষ্ট হচ্ছে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা।
জাতিগতভাবে আমাদের আছে গর্ব করার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। কিন্তু ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের গৌরবজ্জ্বল সংস্কৃতিকে আজ সুকৌশলে কোণঠাসা করছে। তরুণ প্রজম্মের একটা বড় অংশ আজ আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ওপর থেকে অপসংস্কৃতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে প্রজম্মের মস্তিষ্ককে কালচারাল কলোনি বানানো হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে আমাদের জাতীয় জীবনে। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য আমরা জাতীয়ভাবে এর কোনো প্রতিকার করতে পারছি না। এককথায়, দিনে দিনে বিদেশী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষায় দায়িত্বশীলরা যে উদাসীন। তারা কি এমনটি ভাবেন না যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে না পারলে, একদিকে যেমন হারিয়ে যাবে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি, তেমনি আমরা পিছিয়েও পড়ব।
বর্তমানে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে যেভাবে বিদেশী, বিশেষ করে ভারতীয় সংস্কৃতির মোড়কে বাস্তবতা বিবর্জিত কাল্পনিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টিকারী সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। তাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে খুব বেশি দেরি আছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে, ভারতের ফেনসিডিল আগ্রাসনে আমাদের যুব সমাজ শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার পর এবার দেশটির একাধিক টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে রীতিমতো মগজ ধোলাই হতে চলেছে এই জাতির। জন্ম পরিচয় আর নামে মুসলমান হলেও আচার-আচরণে, ভাবনা- চিন্তায় আমরা যেন আজ ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হয়ে পড়ছি। এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমাদের স্বকীয়তা এবং মূল্যবোধ বলতে কিছু থাকবে না। বিশ^ায়নের এই যুগে বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিশ^ সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে হবে। পরিচিত হওয়া মানে এই না যে আমি আমার আপন সংস্কৃতি কে ভুলে গিয়ে অন্য সংস্কৃতির পালন করব।
সংস্কৃতির জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি পরিবার বা সমাজকে কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি রয়েছে। ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতিও রয়েছে। তার চালচলন আর স্বভাবের মধ্যে সেসব পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আমাদের তরুণ তরুণীরা পাড়ি দিবে অজানা গন্তব্যে। রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের সবারই এই বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন। একটি স্বাধীন- সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। অথচ আমাদের এই নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আজ ভিনদেশীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে আগামী দিনে দেশীয় সংস্কৃতিতে আরো ভয়াবহতা নেমে আসবে।
লেখক: কলাম লেখক।