ইউনুস আল মাহমুদ।।
আমরা মানবজাতি। নশ্বর পৃথিবীতে জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটতে গিয়ে আমরা নানাবিধ পাপ করে থাকি। যদি অকপটে বলি, মানুষের দ্বারা পাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে যিনি নিজেকে মুমিন ও মুত্তাকী দাবি করেন, তার দ্বারা কোনো পাপ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক তাকে পরম করুনাময় আল্লাহর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনুল কারীমে সূরা আলে ইমরানের ১৩৫নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন,
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ
অর্থাৎ ‘মুত্তাকী ঐসব লোক, যদি তাদের পাপ হয়ে যায়; তাহলে তারা আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ইস্তেগফার করে নেয়। পাপের উপর তারা হঠকারিতা করেনা। পাপ করেই যাচ্ছি, করেই যাচ্ছি, ক্ষমা চাওয়ার নাম নিশানাও নেই, এমন তারা করে না। বরং পাপ হয়ে গেলে তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয়।’
ক্ষমা করা আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ গুন। তিনি বান্দাকে ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। এ প্রসঙ্গে উপরোক্ত আয়াতের মধ্যাংশে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রশ্ন করেছেন,
وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ
অর্থ্যাৎ ‘আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত ক্ষমাকারী কে আছে?’ এছাড়াও পবিত্র কুরআনে বহুবার আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন,
إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থাৎ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’
প্রিয় পাঠক, এখন পবিত্র রমজান মাস। এ মাসেরই শেষ দশকে লুকায়িত আছে পবিত্র লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদরের ফজিলত কম বেশি সব মুমিন-মুসলমানেরই জানা আছে। তবে লাইলাতুল কদরে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদেরকে ক্ষমা করার যে বিশেষ সুযোগ রেখেছেন, তা অনেকেরই অজানা। সহিহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে আল্লাহ তা’আলার উপর বিশ্বাস রেখে পূণ্যের আশায় ইবাদত করে, তার পূর্ববর্তী সকল পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ আলোচ্য হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, লাইলাতুল কদরে পূর্ববর্তী সকল পাপের ক্ষমা চেয়ে নেয়ার একটি সুযোগ থেকে যায়। তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যেমন-তেমন ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেই পাপ মার্জনা করা হবে না। কিভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে তা সুস্পষ্টভাবে পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা তাহরীমের ৮নং আয়াতে বর্ণিত আছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا
অর্থাৎ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ ও কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো।’ উপরোক্ত আয়াতে কারীমার ভাষ্য অনুযায়ী পাপ মার্জনা চাইলে খালেছ ও একনিষ্ঠভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
আমাদের অনেকেই কদরের রাতে ক্ষমা লাভের আশায় মসজিদে গমন করেন। কিন্তু অজ্ঞতা ও হঠকারিতার কারণেই ক্ষমা হতে বঞ্চিত থেকে যান। এখানে দেখতে হবে, পাপটি কার হক তথা অধিকারের ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়েছে। সেটি কি আল্লাহর হক নাকি তার বান্দার? আল্লাহ তা’আলার অধিকার লঙ্ঘনে যদি পাপ হয়, তবে আশা রাখা যায় একনিষ্ঠতার সাথে তওবা করলে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু যদি তার বান্দার অধিকার লঙ্ঘনের ফলে পাপ সংঘটিত হয়; তবে প্রথমে ওই ব্যক্তির অধিকার তাকে ফেরত দিতে হবে। অধিকারটি যদি ফেরত যোগ্য না হয় তবে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। এমনি করে যদি বান্দার নিকট থেকে ক্ষমা পাওয়া যায়, তবেই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকেও ক্ষমার আশা করা যাবে।
এজন্য একজন মুমিন যদি বাস্তবিক ভাবেই ক্ষমাপ্রার্থী হয়; তাকে ক্ষমা পাওয়ার পন্থা হিসেবে ওলামায়ে কেরাম চারটি পরামর্শ মানতে হবে।
১) যে পাপ হয়ে গেছে সে পাপের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে।
২) যে পাপের জন্য তওবা করতে হবে সে পাপ এখনই ছেড়ে দিতে হবে।
৩) যে পাপ আমি করেছি সে পাপ সামনে আর করবো না মনে মনে দৃঢ় সংকল্প নিতে হবে।
৪) কোন বান্দার হক তথা কারো অধিকার নষ্ট করে থাকলে তার হক আদায় করে দিতে হবে। তাকে পাওয়া না গেলে উত্তরাধিকারীদের কে খুঁজে ফেরত দিতে হবে। যদি তাদেরকেও খুঁজে পাওয়া না যায় তবে ওই পরিমাণ সম্পদ সাদকা তথা দান করে দিতে।
উপরোক্ত চারটি পরামর্শ মেনে যদি কোন মুমিন আল্লাহ তা’আলার দরবারে পাপ মার্জনা চেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে যদি তার পাপরাশি সমুদ্রের ফেনার চেয়েও অধিক হয়ে থাকে, তবুও আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন।
এবার একটু বাস্তবতার নিরিখে তাকিয়ে দেখি, বস্তুতপক্ষে আমরা কয়জনই বা এমন তাওবা করি? আর কয়জনই বা নিজের পাপরাশি ক্ষমা করিয়ে নিতে পারি? আমরা লাইলাতুল কদরে মসজিদে যাই। আবার কৃত্রিমভাবে দু’চার ফোটা চোখের পানিও ফেলি। পরবর্তীতে আবারো নানাবিধ পাপে জড়িত হই। অহরহ অপকৗশল এঁটে অন্যের সম্পদ ও অধিকার ভোগ করি। এমনকি চলমান মহা দুর্যোগকালেও আমরা কেউ কেউ হতদরিদ্র মানুষের ন্যায্য অধিকার আত্মসাৎ করছি।
পরিশেষে প্রিয় পাঠকের কাছে প্রশ্ন রাখছি, প্রতিনিয়ত বান্দার অধিকার হরণ করে স্বীয় পাপরাশির জন্য অনুতপ্ত না হয়ে লাইলাতুল কদরে হাজার ফোটা চোখের পানি ফেললেও কি আমরা আমাদের কৃত পাপের ক্ষমা পাবো? উত্তর অবশ্যই ‘না’। তবে আসুন, কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হই। যাদের অধিকার হরণ করেছি, অধিকার ফিরিয়ে তাদের কাছেও করজোড়ে ক্ষমা চাই। তবেই ক্ষমাশীল ও দয়ালু আল্লাহর কাছে আমরা চূড়ান্ত ক্ষমা পাবো।