স্ত্রী কোহিনূর পারভীন অঞ্জনা (৪০) ও একমাত্র সন্তান এসএম ফারহানকে (১৭) নিয়ে মিরপুর-১৩ নম্বর সেকশনের একটি বাড়িতে বসবাস করতেন সরকার মোহাম্মদ বাইজিদ (৪৭)। মূলত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে জীবিকার তাগিদে ফাস্টফুডের দোকান, গার্মেন্টস এক্সেসরিসের ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করেছেন। তবে কোনও ব্যবসাতেই লাভ করতে পারেননি তেমন একটা। একদিকে ব্যবসায় লোকসান, অন্যদিকে ঋণের পাল্লা ভারী হওয়ায় হাতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। পুলিশ ধারণা করছে, এই হতাশাই থেকে বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) নিজের স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন সরকার মোহাম্মদ বাইজিদ। মৃত্যুর আগে ঘরের দেয়ালে ও কাগজে লিখে গেছেন ৫০টিও বেশি সুইসাইড নোট।
স্বজনদের দাবি, ব্যবসায়িক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন বাইজিদ। ব্যবসার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণও নিয়েছিলেন তিনি। লোকসানের কারণে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বেশ কিছুদিন ধরে দিনরাত বাসায়ই থাকতেন তিনি। এসব মিলিয়ে হয়তো এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন। পুলিশও বলছে, ঘরের দেয়ালসহ বিভিন্ন স্থানে লেখা সব চিরকুট দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বাইজিদ হতাশাগ্রস্থ ছিলেন। তবে এই ঘটনাটি হত্যা, নাকি আত্মহত্যা সেটি খতিয়ে দেখা হবে।
প্রায় ২০ বছর আগে বাইজিদ ও অঞ্জনার বিয়ে হয়। বিয়ের তিন বছর পর তাদের একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। ছেলে ফারহান ঢাকা কমার্স কলেজের একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল।
বাইজিদের স্ত্রী অঞ্জনার মামাতো ভাই কিবরিয়া হোসেন ইনতি বলেন, ‘বাইজিদ মূলত গার্মেন্টসের ব্যবসা করতেন। কিন্তু সেটিতে লোকসান হয়। এরপরও তিনি নানা ধরণের ব্যবসা করেছেন। তবে কোনোটিতে লাভের মুখ দেখেননি। এছাড়াও আমরা শুনেছি তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে কোন কোন ব্যাংক সেটি আমি জানি না। বারবার ব্যবসায় লোকসান হওয়ার কারণে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।’
চিরকুটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ঘরের বাইরে ছিলাম, পুলিশ ছিল ভেতরে। বাইরে থেকে যতটুকু দেখেছি, দেয়ালে লেখা ছিল, ‘স্যরি’ আবার অন্য জায়গাতে লেখা ছিল, ‘আজ আমার ছেলের জ্বর, তাই কোচিংয়ে যেতে পারলো না, স্যরি স্যার।’ আরও অনেক কথা লেখা ছিল। সবগুলো দেখতে পারিনি।’
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, ‘ওই বাসায় গিয়ে আমরা দেখতে পাই ছেলে এবং স্ত্রী বিছানায় পড়ে আছেন। এদিকে বাইজিদ ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে ঝুলে আছেন। ঘটনাস্থল থেকে আমরা বেশকিছু চিরকুট পেয়েছি। ময়নাতন্তের প্রতিবেদন পাওয়া গেলে তিনজনের মৃত্যুর আসল কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
ময়নাতদন্ত শেষে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. একেএম মঈনউদ্দিন বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, তিন জনই বিষ পান করেছে। এর মধ্যে বাবা ফাঁস দিয়ে মারা যায়। তিনজনেরই ভিসেরা সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য মহাখালীতে (সিআইডি) পাঠানো হয়েছে। কেমিক্যাল পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে।’
লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, ওই বাসা থেকে প্রায় ৫০টির মতো চিরকুট পাওয়া গেছে। ঘরের বিভিন্ন দেয়ালে কলমের কালি দিয়ে লেখা, ছোট ছোট কাগজে, বিভিন্ন আসবাবপত্রেও চিরকুটের লেখা পাওয়া গেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা একটি চিরকুটের বিষয়ে বলেন, একটি চিরকুটে লেখা ছিল ‘আমাদের এই মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি প্রথমে আমার স্ত্রী ও সন্তাকে বিষ খাওয়ালাম। নিজেও আত্মহত্যা করলাম।’ এছাড়াও ঘরের দেয়ালে বিভিন্ন জায়গায়, ছোট ছোট কাগজে, টেবিলে এবস চিরকুটের লেখা পাওয়া গেছে।
ডিএমপির মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) খায়রুল আমিন বলেন, ‘মৃত বাইজিদ ঋণগ্রস্ত ছিল কি না, অথবা কোনও ব্যাংক তার নামে মামলা করেছিল কি না, এসব তথ্য এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। এই বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা হবে। অনুসন্ধান করে বিস্তারিত বলা যাবে। তবে যে চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে তা দেখে ধারণা করা যায়, তাদের সংসারে অর্থের টানাপড়েন ছিল।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘ঘরের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে যে চিরকুটের লেখা দেখা যায়, তাতে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে হতাশাগ্রস্ত হয়েই বাইজিদ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। এরপরও আমরা তদন্ত করে দেখবো যে এটি হত্যাকাণ্ড না কি আত্মহত্যা।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন