আমরা কি পিশাচ জাতি হয়ে যাচ্ছি? সব ধরনের বোধ বুদ্ধি কি লোপ পেলো? দু’একজনকে বলা হতো “দয়ার শরীর” যারা দয়া, মায়া, ভালোবাসায় মানুষকে আগলে রাখে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমাদের সবার “পাষণ্ডের শরীর, দানবের শরীর”।
মেডিকেলে পড়ার সময় হোস্টেলে একজন ছিচকে চোর ধরা হয়। আর ওমনি ঐ ছোট্ট কিশোরের উপর হামলে পড়ে আমার “অমিত বিক্রমী” বন্ধুরা। ছেলেটির আহাজারি দেখে আমার মায়া লাগে। তাদের বলি আর এতো মারার দরকার কি, পুলিশে দিয়ে দাও। কয়েকজন আমার দিকে তেড়ে এসে বলে তুমি কি চোরের স্বজন? তারা পারে না আমাকেই মারতে আছে। আমি মানে মানে সম্মান নিয়ে চলে আসছি।
এই বীর পুরুষরা রিফাতকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারতে দেখেও কাপুরুষের মতন ভয়ে পালায়। চারপাশে শত শত অনাচার হচ্ছে তাদের নাকের ডগায় তারা তখন “ভদ্র” সাজে। বলে, আমাদের মানসম্মান আছে, আমরা ভদ্র মানুষ ওদের সঙ্গে ঝগড়ায় লাগবো নাকি?
এরা “শক্তের ভক্ত নরমের জম”। যখন দেখে দুর্বল নারী বা শিশু কিশোরকে, একদল শ্বাপদ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তখন তাদের পশু প্রবৃত্তি, পৈশাচিক স্বভাব বের হয়ে আসে। তারা উন্মত্তের মতন কচি দেহটিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করে আনন্দ পায়। নেকড়ের মতন, পিশাচের মতন পিটাতে, কোপাতে থাকে। অথচ ঐখানে যদি দা, লাঠি, পিস্তল হাতে কেউ মারামারি করে, তাদের কলিজা তখন পানি হয়ে যায়, হৃদপিণ্ড ধুকধুক করতে থাকে।
কখন মানুষ গুজবে বিশ্বাস করে? কখন মানুষ এরকম ভাবে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে নারকীয় কাণ্ড ঘটায়?
মূলত মানুষ যখন দেখে অপরাধীদের পুলিশ ধরছে না বা ধরতে পারছে না; যখন দেখে ধরা পড়লেও সহসা বেড়িয়ে আসবে ও ফিরে এসে আরো নিষ্ঠুর, নির্মম আচরণ করবে; যখন দেখে প্রভাবশালীরা এদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষক, আইন বিচার তাদের কিছু করতে পারবে না; তখন মানুষ নিজের ভিতর নিজেই “স্পেশাল কোর্ট” বানায়। সেই কোর্ট চলে কোন প্রাতিষ্ঠানিক লিগ্যাল প্রক্রিয়া ছাড়া। নিজের কোর্টে তারা “রায় দেয় মৃত্যুদণ্ড”। এবং সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে নিজেকে বা তাদেরকে। একে বলা হয় – lynch।
নিছক সন্দেহ বশত, এমনকি কেউ শত্রুতা করেও যদি রটায়, শিশু অপহরণকারী ধরা গেছে, তখন ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ ও হতাশ জনগোষ্ঠী নিজেরাই “সুবিচার” নিশ্চিত করতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়। অন্যায়, অপরাধকে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রশাসন যখন দেখেও না দেখার ভান করে, এমনকি কখনো কখনো এদের আশ্রয় প্রশ্রয়ও দেয়, তখন মানুষ “জাস্টিস” নিশ্চিত করতে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে।
কিন্তু এরকমটি চললে ঐ মায়ের মতন কত নিরীহ, নিষ্পাপ মানুষ যে এর বলি হবে এটাতো প্রত্যক্ষই দেখা যাচ্ছে।
প্রতিকার কী, কে করবে প্রতিকার?
লেখক: মনোরোগবিদ্যা বিভাগ,
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল,
শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।