আমিনা আক্তার প্রিয়া:
ফেসবুক এখন “মা দিবস” ময়। প্রতি বছর মা দিবস আসে-যায়, আর মায়েরা-সন্তানেরা তাদের যাপিত জীবন নিয়ে এগিয়ে যায়, গুটিয়ে যায়, হারিয়ে যায়। তবে রেখে যায় প্রথাগত কিছু বদ্ধ ধারণা, সংকীর্ণ করে দিয়ে যায় আমাদের চিন্তার জগতকে। সীমাবদ্ধ করে দেয় আমাদের ভালোবাসার-ভালো রাখার পরিধিকে। আমাদের কাছে মা মানেই মহান কেউ-যিনি নিজেকে বিলিয়ে দেন সন্তান আর সংসারের কল্যাণে। যিনি সর্বাংসহা হয়ে পার করে দেন এক জীবন যে জীবন তার নিজের নয়, পরিবারের অথবা সমাজের। যিনি সমস্ত ঝড়-ঝাপটা পিঠ দিয়ে আড়াল করে সন্তানদের কে নিরাপদে রাখেন নিজের বাহুডোরে।
মায়ের পরম মমতায় তিরতির করে লতার মতো বেড়ে উঠে সন্তানেরা। অর্থাৎ আমরা ধরেই নিই মায়েরা হবে নির্লিপ্ত, ত্যাগী, মমতাময়ী, নিঃসার্থ। তারা নিজেদের নিয়ে ভাববেনা, তারা অসুস্থ হবেনা, তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকবেনা, তাদের নিয়ে গল্পের আসর জমে না, খাবার টেবিলে তাদের পছন্দের খাবার না থাকলেও চলে তবে অন্যদের জন্য পঞ্চব্যঞ্জনে টেবিল না সাজালে সংসার চলেনা। মোদ্দা কথা সংসার আর সন্তানদের নিয়ে উৎকণ্ঠা, চিন্তা আর প্রার্থনায় কেটে যাবে মেয়েদের “মা-বেলা”।
এই মা-বেলায় ভালো খাবারটা তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য তুলে রাখবে, কে কখন কি খাবে, কি পরবে, কোথায় যাবে, কার ক্লাস টাইম বা অফিস কয়টায় সেই হিসেবের ভারটা থাকবে মায়ের কাধে। নিজে দুখানা কাপড় দিয়ে বছর পার করলেও সন্তানদের দিবে সব চেয়ে সুন্দর পোশাকটা। কড়ায়-খুন্তি-চুলা-ফার্নিচারের ধুলা-টয়লেটের হারপিক-বালিশের কভার-তরকারীওয়ালা-জায়নামাজ-টেবিল রানার-ব্যালকনির কিছু গাছপালা-চায়ের কাপ…এসব নিয়ে বেলা শেষের ঘন্টা বাজে বেশিরভাগ মায়েদের জীবনের। অথবা সবজি হাতে অফিসফেরত ক্লান্ত মা, সন্তানদের পড়ার টেবিল, বাজারের লিস্ট, জানালার ধুলো, গরম-গরম লুচিভাজি,খাসির মাংস-সেই একই রকম খুন্তি -কড়ায়, একই রকম ক্লান্তি, একইরকম গল্প।
অথচ বাস্তবের মায়েরা কেউ দেবী দুর্গা নন, তারা শাবানার মতো সর্বংসহা নন, তারা ববিতার মতো ম্যাজিকেলি জীবনটাকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে ফেলতে পারেননা। কারণ তারা মানুষ, তাদের ক্লান্তি আছে, কোমরে ব্যাথা আছে, হাড়ের ক্ষয়রোগ আছে, মাথা ধরার ব্যরাম আছে, চোখের ভেতর আগুন আছে, বুকের মাঝে দীর্ঘশ্বাস আছে, মনের কোণে স্বপ্ন আছে, কারোর জন্য ঢেউয়ের মতো তীব্র ঘৃণা আছে,কারোর জন্য আকাশসমান ভালোবাসা আছে। তাদের নিজেদের একটা গল্প আছে, নিজেকে নিয়ে একথাল স্বপ্ন আছে, তাদের ভেতর একটা চপলালক্ষ্মী লুকিয়ে আছে অথবা তারা সন্তর্পনে লুকিয়ে রাখে সেই লক্ষ্মী -চঞ্চলাকে।
আমরা সন্তানেরা কেউ মায়েদের সেই অজানা গল্পটা জানতে চাইনা, তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অষ্টাদশীর খবর আমরা জানিনা, আমরা বুঝতে চাইনা তাদের দীর্ঘশ্বাস, তাদের চোখের কোণের স্বপ্নটা আমরা দেখিনা। আমরা জানিনা বর্ষার রিনিঝিনি তাদের কানে কেমন বাজে, শীতের কোমল রোদে গা এলিয়ে দিলে তাদের কেমন লাগে, দোলনচাঁপার গন্ধ তাদের মাতিয়ে তুলে কিনা, বেগুনভাজির সাথে ভুনাখিচুড়ি তাদের পছন্দ কিনা। এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়??? অথচ মায়েরাও চায় চায়ের কাপ হাতে কিছুক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে, খোলা আকাশের নিচে বুকভরে শ্বাস নিতে, সমুদ্রের নোলাজলে পা ভেজাতে, জ্যোৎস্না রাতে নিজের মানুষটাকে নিয়ে গল্পের ঝাপি খুলে বসতে।
কবিতার বইটা খুলে বসার জন্য তারা সময় খুঁজে বেড়ায় অনন্তকাল ধরে, তাদের তানপুরায় ধুলার আবরণ পড়ে। মায়েরাও চায় কেউ তাদের সাথে একটু গল্প করুক, কেউ তাদের জিজ্ঞেস করুক শরীর ঠিক আছে কিনা, তাদের কি খেতে ভালো লাগে, কি করতে ভালো লাগে…কিন্তু এমন কেউ কোথাও নেই যারা তেল-নুন-বিলের কাগজের বাইরেও অন্য কিছু নিয়ে তাদের সাথে কথা বলবে। তাই বলে ছোট্ট এই জীবন নিরানন্দে কাটবে?? আপনজনদের কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পাওয়ার আশায় কি অপেক্ষামান থাকবে মায়েরা???
নিজেকে ভালোবাসা ভীষণ জরুরি।কারণ নিজে ভালো না থাকলে অন্যকে ভালো রাখা যায় না কখনো। তাই বদ্ধ ঘরের দরজা খুলে তারা শ্বাস নিক মুক্ত বাতাসে, দেয়ালের অফ-হোয়াইট কালারের সাথে ডার্ক ব্লু কালারের একটা শাড়ী গায়ে জড়িয়ে নিক মায়েরা, ঘরের ঝুল ঝাড়তে-ঝাড়তে নিজের ঝুলে থাকা চোয়ালটা দেখার জন্য আয়নার সামনে দাড়াক, মুরগির রান খেতে তারাও পছন্দ করে সে কথা অন্যদের জানাক,বাচ্চার কপালে টিপ আঁকতে গিয়ে নিজেও চোখে একটু কাজল পরুক, পাড়ভাংগা শাড়ি পরে একটুখানি সাজুক, বাচ্চাদের সাথে হাতি-ঘোড়া খেলার পাশাপাশি নিজেও একটু ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুক, নিউজফিডে স্ক্রল করতে-করতে হাসি ফুটুক মুখে, মাঝে মাঝে একটা লম্বা ঘুম দিক। নিজের যত্নে নিজেই ভালো থাকুক, ভালো রাখুক অন্যদেরও। মায়েরা মেয়ে থাকুক, মায়েরা লক্ষ্মী চঞ্চলা হয়েই থাকুক, মায়েরা ভালো থাকুক আপন আঙ্গিনায়। আপন যত্মে, রংগে আর ঢংগে কাটুক মেয়েদের “মা-বেলা”।
লেখিকা: কলামিষ্ট, আবৃত্তিকার।