সংসারের কর্তার পকেটে টাকা নেই… গিন্নি রাতে শোয়ার সময় ভয়ে ভয়ে বললো, চালের ড্রাম শেষের দিকে আজ পাশের বাসার সোমা ভাবি থেকে এক কাপ তেল ধার এনে তরকারি রান্না করেছি।
গৃহকর্তা নিথর নিরব। কি করবে ভাবছে! গিন্নি এবার কিছুটা কান্না গলায় বললো, জানো, আজ মেয়েটাকে মেরেছি।
অন্য সময় হলে বাপন চন্দ্র শীল হৈচৈ বাধিয়ে দিতেন, আমার মেয়েকে মারলে—- কিন্তু সে আজ শক্ত পাথর! তার চিন্তা জুড়ে বরং সন্তান দু’টির মুখে খাবার কি করে তুলে দিবে, নিজেরাও কেমন করে বাঁচবে।
লক্ষি রানী শীল চাপা স্বারে বললো, মেয়েটা বলে তার জেঠার বাসায় প্রতিদিন নতুন নতুন পদ রান্না হয়। আজ বললো, আম্মু জেঠি মা মোরগ পোলাও রান্না করেছে, কি সু-গন্ধ.. আমিও খাবো। তার প্রতিদিনের প্রশ্ন, বাবা আগে প্রতিদিন কত কিছু আনতো, এখন কেন বাজারে যায়না? তার পছন্দের ডুরিয়া বিস্কুট প্রতিদিন আনতো এখন কেন আনেন না! আজ একটু বেশি বিরক্ত করেছে বলে কতক্ষণ মনমতো মারলাম মেয়েটাকে। সেই থেকে সারাদিন বুকটা জ্বলছে।
বাপন শীল লাকসাম জংশন বাজার সেলুন ব্যবসা করে। মোটামুটি ভালই আয় হয়। দোকান খরচ বাদে প্রতিদিন গড়ে হাজার টাকা থাকে। দালান ঘরটা তুলতে বেশ কিছু ধারদেনা হয়ে যাওয়াতে সাংসারিক ব্যায়ের অতিরিক্ত টাকাটা তাই চলে যায় ঋণ পরিশোধে। করোনা আসার পর সরকারের নির্দেশনা মেনে বাপন ঘরেই থাকে। প্রথম দশ দিন ঠিক মতো চললেও এর পর থেকে শুরু হয় টানাটানি। বাপন চন্দ্র শীল ঠিক ভাবতে পারছে না কি করবে।
বড় ভাইয়ের কাছে চাওয়া ঠিক হবে কিনা এটা নিয়ে বাপনের মধ্যে দ্বন্ধ কাজ করছে। বড় ভাই চলন চন্দ্র শীল ইতালী থেকে ফিরেছিন লক ডাউনের আগের দিন। চলন শীল এখনো পুরনো ঘরটাতেই থাকে অথচ ছোট ভাই বাপন পাকা ঘর করে ফেলেছে! আজ পাকা ঘরটাই বাপনের কাল হয়ে দাড়ালো! এখন ঘনিষ্টরা হিংসা করা শুরু করেছে। কানাঘুষা করছে, বাপনের অনেক টাকা হয়ে গেছে। দালান দেয়ার আগে সুখে দুঃখে বড় ভাই চলন শীল বাপনের খোঁজ খবর নিতো বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করতো। এবার দেশে এসে ঠিক মতো কথাই বলে না। চলনের ঘরে নিত্য পার্টি হচ্ছে, তার বন্ধুরা আসছে আড্ডা দিছে, ভালমন্দ খাচ্ছে আর রাতভর বিদেশী মদ গিলছে। অথচ পাশের ঘরে ছোট ভাই বাপন আগামীকাল কি খাবে তা ভেবে পাচ্ছে না।
বাপনের মন সায় দিচ্ছে না বড় ভাইকে নিজের সমস্যার কথা কিছু বলবে। কারণ বলে কোন লাভ হবে না সে জানে। গতকালকে ত্রাণের চালের জন্য এলাকার কাউন্সিলরের সাথে গোপনে দেখা করেছিল বাপন। কাউন্সিলর বিরক্তির সুরে জবাব দিলেন, দেখ ভাই বাপন আগে গরিব মানুষদেরকে দিয়ে নেই, তোরা দালান ঘরের মালিকরাও যদি এতো তাড়াতাড়ি ডিস্টার্ভ করা শুরু করিস তাহলে কিভাবে সামলাবো বল! খালি হাতে ফিরে আসার সময় বাপন পরিস্কার শুনতে পেল কাউন্সিল বাবুল হাজী’র কন্ঠ, শালার মানুষ কেমনে এতো লোভী হয়? লজ্জায় মুখ লাল করে বাপন ফিরে এসেছিল।
পাশে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে লক্ষী রানি শব্দহীন কেঁদে যাচ্ছে। হঠাৎ করে বাপনের মোবাইল বেজে উঠায় কান্না থামলো। ফোন করেছে সারমিন। সারমিন বাপনের স্কুল জীবনের সহপাঠি বন্ধু। সে কুশল বিনিময় শেষে বললো, দোস্ত আমরা আমাদের এস.এস.সি-২০০০ ব্যাচের বন্ধুরা মিলে করোনায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য তহবিল গঠন করেছি। ইতিমধ্যে এক লক্ষ বাইশ হাজার পাঁচশত টাকা জমা হয়েছে। বাপন বললো, ফেসবুকে দেখিতো তোদের এসব, আমার ভাল লাগে। গ্রুপটাকে অল্প দিনে বেশ জমিয়ে তুলেছিস! তবে সবাই একতাবদ্ধ থাকলে বড় কিছু করা সম্ভব। দেখিস একটু ভাল করলেই নিজেরা ক্ষমতা নিয়ে ঝগড়া লেগে দুই তিন ভাগ হয়ে যাইসনা। আমাদের বাংলাদেশের মানুষ আবার সব কিছুতেই ক্ষমতার কাড়াকাড়ি ও দলাদলি না করে থাকতে পারে না। সবাই নেতা হতে চায়।
সারমিন বললো, না বন্ধু, আমাদের সব বনন্ধুদের মধ্যে ছাড় দেয়ার মানসিকতা আছে। আর গ্রুপ খুলতে না খুলতে এমন একটা তহবিল গঠন করে এতা টাকা যোগাড় করতে পারাতো আন্তরিকতারই প্রকাশ তাই না? তবে বন্ধু তোকে ফোন দিয়েছি ভিন্ন কারনে। আসলে আমাদের সহপাঠিদের পাশে দাড়াতে এই তহবিল গঠন হয়েছে, তোর পরিচিত কোন বন্ধু যদি সমস্যায় থাকে আমাকে জানাইস।
বাপন জানে সারমিন তাকে বলার সাহস না পেয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথাটা বলেছে। অবশ্য বাপনের কিছু টাকা এখন খুব দরকার, মাথা ঘুরছে দুঃশ্চিন্তায়। কিন্তু সে বলবে কেমন করে কথাটা? তাও সারমিনকে…